নির্বাচিত দুই কবি, একটি জুটি। বেছে নিলেন প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা। বদলে দেওয়া হল বাক্স।
একে অন্যের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণ করলেন। আবার বাক্সবদল।
নিজের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণের আলোচনা করলেন কবি-জোড়।
অলোক
বিশ্বাস-এর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা
গান্ধীনগরে
এক রাত্রি ।। মনিভূষন ভট্টাচার্য
গোকুলকে সবাই জানে, চিনে রাখল ভি. আই. বি’র লোক
স্টেটসম্যান পড়ার ফাঁকে
আড়চোখে, গোকুলের
মা
অন্ধকার ঘন হ’লে বলেছিলো, ‘আর নয়, এবার ফিরে যা’ -
ফেরার আগেই খাকি রঙের
বিদ্যুৎ দরজায়,
রিভলবার গর্জে ওঠে, গর্জায় গোকুল,
রাষ্ট্রীয় ডালকুত্তা
ঝুঁকে ছিঁড়ে নিল এক খাবলা চুল
রাতকানা মায়ের চোখে
কুরুক্ষেত্রে বেল্টের পিতল, বুট,
জলস্রোতে নামে অন্ধকার,
শবচক্র মহাবেলা প্রশস্ত
প্রাঙ্গণ,
পাথরে পাথরে গর্জে কলোনির
সুভদ্রার শোক।
অধ্যাপক বলেছিলো, ‘দ্যাটস রঙ, আইন কেন তুলে নেবে হাতে?’
মাষ্টারের কাশি ওঠে, ‘কোথায় বিপ্লব,
শুধু মরে গেল অসংখ্য হাভাতে!’
উকিল সতর্ক হয়, ‘বিস্কুট নিইনি,
শুধু চায়ের দামটা রাখো লিখে।’
চটকলের ছকুমিঞা, ‘এবার প্যাঁদাবো শালা
হারামি ও.সি-কে।’
উনুন জলেনি আর, বেড়ার ধারেই সেই
ডানপিটের সেই তেজী রক্তধারা,
গোধুলিগগনে মেঘে ঢেকেছিল
তারা।
যে
বিস্মৃতিতে আমার পুরোনো মাছগুলো রয়েছে ।। গোলাম রসুল
এক সুদীর্ঘ নদী আসতো আমার
নরম বিছানায়
আধো ঘুম অবস্থায় আমাকে
কল্পনা করতে শেখাতো
পৈতৃকসূত্রের এই বাড়ি
থেকে জ্ঞাতিগোষ্ঠীরা চলে গেছে অনেক দূরে
শুধু পাশের ঝোপ জঙ্গল
শুধু মৃতরা সাড়া শব্দ করে
মাটির পেয়ালায় রাখা
পূর্ণিমার চাঁদ ধড়ফড় করছে
সন্ধ্যার কলরব
উঠোনে সারারাত্রির
অনুষ্ঠানসূচি
চাঁদের আলোয় জলের ভেতরের
মাছেরা যেমন খেলা করে তেমনি আমার ভাবনায় আবার
খেলতে শুরু করেছে হৃদয়ের
সেই প্রথম বর্ষার কলমিতারা
আর আমি তাতে জুড়ে দিলাম
বিগতকালের বৃষ্টি ঝরা
গভীর রাত্রি
জল বাড়ছে
আমার গায়ের জ্বর এখন
শতাধিক তাপমাত্রা ছাড়িয়েছে
অদূরের খামারের খড়ের গাদা
থেকে বিচালির হাওয়া আসছে
ওলের গায় ভূতপূর্ব
পৃথিবীর সবুজ সাদা নকশা
ব্যাঙেরা দু’একটা ছাতা রেখে গেছে
গ্রামের গৃহস্থদের জন্য
অনেকদিন নদীটি আর আসে না
আমি ভুলে গেছি কল্পনা
করতে যা যা দরকারী বিষয়গুলো লাগে
কখন চাঁদ ওঠে জানি না
শুধু যে বিস্মৃতিতে আমার
মাছগুলো রয়েছে তাঁদের ছেড়ে দিয়েছি চোখের দেখায়
কেননা পাথর আমাকে কাঁদতে
বারণ করে গিয়েছিলো
ফলস্ ।। প্রদীপ চৌধুরী
আমার এক একটা জন্ম আমার
পাৎলুন ছিন্নভিন্ন
করে দিয়ে আমাকে রেখে যায়
এই শহরের সময়হীন
গুহার ভেতর -
কোলাহলপূর্ণ ছায়া
এবং শিশুর চীৎকার ও পীত
চোখের ছায়া, জল। আঘাত করার
জন্যে কিছুতেই ব্যবহার
করতে পারছিনা তোমাকে। তোমার জরায়ুর
আঁশের সঙ্গে মাখামাখি
আমার কবন্ধ দেহ এবং পৃথিবী
ক্যালকাটা সেলুনের চেয়ার
গুলিও খেয়ে ফেলেছে আমার শরীরের
জলোচ্ছ্বাস, খেয়ে ফেলে নির্ঘাৎ
কোন জায়গায় অকেজো ইঞ্জিনের
মতো ঝুলে থাকবে ডিসেম্বর
থেকে ৫ই ফেব্রুয়ারি অব্দি, ডিয়ার সুভাষ
ডিয়ার মলয়, সেদিন আরেকবার জুয়া
খেলব ফাঁকা পকেটে আর
একবার
খুলির ভেতর থেকে চোখগুলি, মৃত গণিকার জন্মদিনে
প্রেমিকার অংটিগুলি
নেশার টেবিলে রেখে জুয়া
খেলব - এভাবেই দিনগুলি
তাসের ভাঁজের ঠিক কাছাকাছি
এসে সটকে পড়ছে আমাকে
ছাড়াই আমার ২৪ জন্মদিন -
৫ই ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৩ই এপ্রিল
বিনির্মাণ
করলেন ইন্দ্রনীল ঘোষ
বিপ্লব ।। ইন্দ্রনীল ঘোষ
আড়চোখ ঘন হ’লে,
রঙের বিদ্যুৎ ওঠে
পিতলের মা পিতলেরই শোক টের পায়
এক খাবলা প্রশস্ত ঢেলে দেয় পাতে
উনুনের ধার দিয়ে বিপ্লব আসবে বলেছিল
হাভাতে মেঘের কাছে বিপ্লব আসবে বলেছিল...
সূত্র: গান্ধীনগরে এক রাত্রি
।। মনিভূষন
ভট্টাচার্য
চাঁদ ।। ইন্দ্রনীল ঘোষ
সুদীর্ঘ ধড়ফড় করছে মাটির পেয়ালায়
সেই তেষ্টা...
জলের ভেতর মাছে অনুষ্ঠানসূচি
কলরব-খেলা সেই প্রথম বর্ষার...
এক পৈতৃকসূত্রের চাঁদ আমাকে কল্পনা করতে শেখাতো —
নরম বিছানার আধো
উঠোনের সারারাত্রি
খামারের নকশা
সেই জ্বর, তাপমাত্রা
গভীর ছাড়িয়েছে...
সূত্র: যে বিস্মৃতিতে আমার পুরোনো মাছগুলো রয়েছে ।। গোলাম রসুল
অঙ্কবিতা ।। ইন্দ্রনীল ঘোষ
৫ই ফেব্রুয়ারি কিংবা ১৩ই এপ্রিল
৫.০২ + ১৩.০৪
= ১৮.০৬
জুয়া খেলব তাসের ভাঁজের ঠিক কাছাকাছি
১৮ | ভাঁজ |
০৬
১৮ + ০৬
= ২৪
আমার ২৪ জন্মদিন
সূত্র: ফলস্ ।। প্রদীপ চৌধুরী
অলোক বিশ্বাস
একটি লিখিত কবিতার পুনর্নির্মাণ বা বিনির্মাণ নতুন এক ভৌগোলিক দ্রবণ। এই বুনন কর্মশালায় পুনর্নির্মিত কবিতার উত্তাপ পাঠকের চেতনায় সঞ্চারিত হতে সময় লাগে অথবা কখনো প্রত্যাখ্যাত হয়। কেননা পাঠকের মনন সত্তা যেভাবে নিবিষ্ট থাকে পূর্বলিখিত কবিতাটির কাছে, তার সুর ও লয়ের কাছে, তার ধ্বনি ও গঠনগত রূপ ও ভাষার কাছে, কবিতাটির পুনর্নির্মাণ সেই বিভাসা আর দিতে পারে না বলে ধারণা অধিকাংশ পাঠকের। 'আকাশ ভরা সূর্য তারা, বিশ্ব ভরা প্রাণ'- এই গানটির দ্বিতীয় হয় কিনা আমরা ভাবি। হলেও তা কেমন হবে ভেবে সারা হই। আমরা যে সুর ও ভাষা আয়ত্ত করেছি, তাতে এর দ্বিতীয় করা যেতেই পারে। কিন্তু সেটার গ্রহণযোগ্যতা বিষয়ক অবস্থা আমাদের চঞ্চল করবেই। বিনির্মিত রূপটিকে পাঠক আত্মীকরনে গররাজী হয়, যদি না সেটা জনপ্রিয় রূপের সমতুল্য হয়ে উঠতে পারে। ভারতবর্ষের প্রধান দুটি এপিকের বিভিন্ন অংশ বারেবারে পুনর্নির্মিত হয়েছে নাটকে উপন্যাসে গল্পে পেইনটিংসে। খাপ খেয়ে গেছে, কারণ ওই দুটি মিথের গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নহীন। ওই দুটির পুরোটাই বা নির্দিষ্ট অংশ বিনির্মিত হতে দেখলে পাঠক শ্রোতা দর্শক অন্যরকম রসদ পায়। যদিও এর সঙ্গে যুক্ত আছে এক অভ্যাস। আবহমান ধর্মীয় মানস প্রবণতা। ঝুঁকিহীন এই গ্রহণ। আবার, এ থেকে রসদ পাওয়া যায় কারণ তাতে পরবর্তী কালখণ্ডের চিন্তাবোধ এবং আনন্দ দুঃখের সঞ্চার সংযুক্ত হয়ে আছে। বহু সংগীতের রিমিক্স দেখি আমরা, এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় রূপান্তরিত হয়েছে মূল সুর বজায় রেখে। তরুণ কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ অগ্রজ কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্যের 'গান্ধীনগরের এক রাত্রি' কবিতাটির পুনর্নির্মাণ করেছেন রেহেলের জন্য। মণিভূষণের কবিতার জীবন যন্ত্রণার তীব্রতর ছড়ানো রূপটি ইন্দ্রনীলের পুনর্নির্মিত 'বিপ্লব' কবিতায় নিয়ন্ত্রিত রূপ অর্জিত হতে দেখি। যে আবেগ ভাষিত মণিভূষণে, ইন্দ্রনীল তাকে অতিরেক মনে করে বর্জন করেছেন। সীমায়িত করলেন বলা যায় কি? মণিভূষণে আপাদমস্তক নাটকীয়তা ছিল। স্বৈরাচারী রাজনৈতিক অবস্থার সঙ্গে কয়েক যুগ আগে সেটা ছিল মানানসই। কবিতায় নাটকীয় রেশ টানা। প্রথা ছিল। ইন্দ্রনীল এড়ালেন। ন্যারেটিভ অবস্থাকে ধাক্কা মেরে হ্রাসিত করলেন। সংলাপ বর্জন করলেন। নামকরণে মূল ভাবনাটাকেই নিলেন। মূল চেতনাটিকে মূর্ত রেখে বাদবাকি তাঁর পুনর্নির্মাণে ভিন্ন রূপ পেয়েছে বলা যায়। মণিভূষণ সম্পূর্ণতায় নিবিষ্ট। একটি স্পষ্ট বার্তা দেওয়া স্বাভাবিক ছিল তাঁর কাছে। ভেগনেস রাখেননি। ইন্দ্রনীলের পুনর্নির্মাণে স্পেস রাখা আছে। মূল রচনাটি পাঠের পর সেই স্পেস পূরণে পাঠকের দ্বিধা থাকার কথা নয়। কিন্তু যদি মূল রচনাটি পাঠ না হয়, তালে স্পেস পূরণে পাঠক নিজের ভাবনা পরিসরের ওপর নির্ভর করবেন, এটাই ধরতে হবে। স্থা-অবস্থাকে নাড়াবার অক্ষর উভয় কবিতায় বজায় রইলো, সেটা বলা যায়।
দ্বিতীয় কবিতা গোলাম রসুলের 'যে বিস্মৃতিতে আমার পুরনো মাছগুলো রয়েছে'। ইন্দ্রনীলের নির্মাণে এই কবিতার অভিধা 'চাঁদ'। প্রথমটির মতোই এখানেও ইন্দ্রনীল সারাৎসারে মজেছেন। কিন্তু লজিক্যাল ক্লেফট যতোটা দৃশ্যমান গোলামের কবিতায়, ততোটাই লজিক্যাল ক্লেফট থেকে সরে আছে ইন্দ্রনীলের পুনর্নির্মাণ। ভাষার প্রজন্মগত বৈসাদৃশ্য থাকবেই। অবশ্য একে আমি চিহ্নিত করি মনস্তাত্বিক দূরত্ব হিসাবে। কবিতাটির গঠনগত রূপভেদও স্পষ্ট পুনর্নির্মাণে। গোলামের কবিতায় প্যাশন যেন ফেটে বেরোচ্ছে। ইন্দ্রনীলে যেটা অনুপস্থিত। ব্যক্তিগত জীবন পরিসর পৃথক পৃথক প্যাশন তৈরি করে। কবিতার পূর্বনির্ধারিত ভালোমন্দ বিচারের সময় আর নেই। কবিতায় বার্তা প্রেরণের পদ্ধতি পূর্বেকার নির্গমনের মতো নয় আজ। ইন্দ্রনীলের পুনর্নির্মিত 'চাঁদ' কবিতার প্রথম স্তবকে চাঁদের কোনো প্রসঙ্গ নেই, আপাতভাবে। দ্বিতীয় স্তবক পাঠের পরেই প্রথম স্তবক প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে চাঁদের সাজুয্যে।
গোলাম রসুল লিখলেন-
'মাটির
পেয়ালায় রাখা পূর্ণিমার চাঁদ ধড়ফড় করছে'।
কবি
ইন্দ্রনীল লিখলেন- '
সুদীর্ঘ
ধড়ফড় করছে মাটির পেয়ালায়'।
তৃতীয় পুনর্নির্মিত কবি প্রদীপ চৌধুরীর 'ফলস- প্রদীপ চৌধুরী'। ইন্দ্রনীল পুনর্নির্মাণ করে নাম দিয়েছেন 'অঙ্কবিতা'। এখন ভাবা যাক, একটা পড়ার টেবল। অন্যান্য সমস্ত বইপত্র খাতা সরিয়ে অঙ্ক-বিষয়ক যা কিছু রাখা। আর চেয়ারে বিষয়ী। বিষয়ীকে প্রশ্ন দেয়া হয়েছে, তার কতো-তম জন্মদিন, সেটা আঙ্কিক ক্যালকুলেশন দেখাতে হবে। কিছু সূত্র দেওয়া আছে পাশে। তাও আঙ্কিক। বিষয়ী এগোলেন। সফলভাবে জয় করলেন। বাধ্য ছাত্রের মতো। অর্থাৎ সিদ্ধান্তমূলক উত্তরে পৌঁছলেন। কিন্তু সমস্যা হলো বিষয়ী একজন কবি। সমস্যা হলো বিষয়ী তাঁর কবিত্বকে আপাতত ভুলে গেলেন অঙ্কের ক্লাসে। পাশে কিছু বাংলা অক্ষর রয়ে গেল ঠিকই। কিন্তু তাদেরকে চুপ থাকতে বলা হলো। হাসতে নাচতে কাঁদতে মানা করা হলো তাদেরকে। তারা শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। অঙ্কের ক্লাস। স্যার বলে দিয়েছেন, অঙ্ক বিনা অন্যকিছু নহে। গাছ লতাপাতা পোকামাকড় চাঁদ সূর্য সমাজ জলোচ্ছ্বাস প্রেমিকা সেলুন- অন্য কোনো প্রসঙ্গ আসবে না অঙ্কের ক্লাসে। শুধু ক্যালকুলেশন। ফলে জন্মদিন এলো নীরবে, তাস এলো নীরবে অদৃশ্য রূপ হয়ে। এপ্রিল বা ফেব্রুয়ারি এলো নীরবে। অঙ্কের মজা তাদেরকে উপস্থিত হতে দেয়নি শরীর সমেত। অঙ্কের প্রফেশনাল অস্ত্র তাদের চক্ষু নামিয়ে রাখতেই বলেছে। ফলত যে তারণা যে বিবমিশা যে ক্রোধ যে আংটি যে জলোচ্ছ্বাস প্রদীপ চৌধুরীকে অস্থির করে দিলো সেই অনুভব্য ছিন্নভিন্নতা অঙ্ক নামক ঝক্কাস ক্লাসে ঢুকতে পেলো না কোনোমতে। সম্পর্কের ছিন্নভিন্নতা কবিকে বা বিষয়ীকে ভেতর ভেতর হয়তো ভাবালো, হয়তো ভাবালোই না। জন্মদিন এলেও, তা এলো কেবল একক সংখ্যা হিসাবে। চেতনা ছাড়াই। ফোকাস পেলো মাত্র একটি সংখ্যা। সমাধানের উত্তর সেই সংখ্যা, উৎপাদক উৎপাদন সম্পর্কে যার জন্ম। পৃথিবীর ঝড়বাদল, চোখের ইশারা ও জল, ধারাবাহিক জার্নি ও নিবিড় করে পাওয়া আনন্দ, মোটিভেশনাল ফুটপাথগুলি কোথায় হারিয়ে গেল। পুনর্নির্মাণ কি এইসব হারায় ইন্দ্র ? হারাতে চায় ? পারে ? কেবল কি অঙ্কই এলো প্রদীপের পাঠশালা থেকে ?
ইন্দ্রনীল ঘোষ-এর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা
আবোল –তাবোল ।। সুকুমার
রায়
মেঘমুলুকে ঝাপসা রাতে,
রামধনুকের আবছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠপুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাই রে বাঁধন নাইরে
বাধা।
হেথায় রঙিন আকাশ তলে
স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে
রাঙিয়ে আকাশ, রাঙিয়ে
মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাওয়ার আগে
বলব যা মোর চিত্তে লাগে
নাই বা তাহার অর্থ হোক
নাই বা বুঝুক বেবাক লোক
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।
ছুটলে কথা থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাইধপাধপ তবলা বাজে-
রাম খটাখট ঘ্যাঁচাঙঘ্যাচ
কথায় কাটে কথার প্যাঁচ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার ,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
হ্যাঙলা হাতি চ্যাংদোলা
শুন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা।
মক্ষীরানী পক্ষীরাজ
দস্যি ছেলে লক্ষী আজ।
আদিম কালের চাদিম হিম,
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এলো ঘুমের ঘোর
গানের পালা সাঙ্গ মোর।
বোধ ।। জীবনানন্দ
দাশ
আলো-অন্ধকারে যাই—মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
স্বপ্ন নয়, কোন্ এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাত রাখে হাতে,
সব কাজ তুচ্ছ হয়—পণ্ড মনে হয়,
সব চিন্তা—প্রার্থনার সকল সময়
শূন্য মনে হয়,
শূন্য মনে হয়।
সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে।
কে থামিতে পারে এই আলোয় আঁধারে
সহজ লোকের মতো; তাদের মতন ভাষা কথা
কে বলিতে পারে আর; কোনো নিশ্চয়তা
কে জানিতে পারে আর? শরীরের স্বাদ
কে বুঝিতে চায় আর? প্রাণের আহ্লাদ
সকল লোকের মতো কে পাবে আবার।
সকল লোকের মতো বীজ বুনে আর
স্বাদ কই, ফসলের আকাঙ্ক্ষায় থেকে,
শরীরে মাটির গন্ধ মেখে,
শরীরে জলের গন্ধ মেখে,
উৎসাহে আলোর দিকে চেয়ে
চাষার মতন প্রাণ পেয়ে
কে আর রহিবে জেগে পৃথিবীর ’পরে?
স্বপ্ন নয়—শান্তি নয়—কোন্ এক বোধ কাজ করে
মাথার ভিতরে।
পথে চ’লে পারে—পারাপারে
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।
আমি থামি—
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
উপেক্ষা করিতে চাই তারে;
মড়ার খুলির মতো ধ’রে
আছাড় মারিতে চাই, জীবন্ত মাথার মতো ঘোরে
তবু সে মাথার চারিপাশে,
তবু সে চোখের চারিপাশে,
তবু সে বুকের চারিপাশে;
আমি চলি, সাথে-সাথে সেও চ’লে আসে।
আমি থামি—
সেও থেমে যায়;
সকল লোকের মাঝে ব’সে
আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা?
আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?
আমার পথেই শুধু বাধা?
জন্মিয়াছে যারা এই পৃথিবীতে
সন্তানের মতো হ’য়ে—
সন্তানের জন্ম দিতে-দিতে
যাহাদের কেটে গেছে অনেক সময়,
কিংবা আজ সন্তানের জন্ম দিতে হয়
যাহাদের; কিংবা যারা পৃথিবীর বীজখেতে আসিতেছে চ’লে
জন্ম দেবে—জন্ম দেবে ব’লে;
তাদের হৃদয় আর মাথার মতন
আমার হৃদয় না কি? তাহদের মন
আমার মনের মতো না কি?
—তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী।
হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল?
বাল্টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্ৰ—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
বাল্টিতে টানিনি কি জল?
কাস্তে হাতে কতোবার যাইনি কি মাঠে?
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, বাতাসের মতন অবাধ
বয়েছে জীবন,
নক্ষত্রের তলে শুয়ে ঘুমায়েছে মন
এক দিন;
এই সব সাধ
জানিয়াছি একদিন—অবাধ—অগাধ;
চ’লে গেছি ইহাদের ছেড়ে;
ভালোবেসে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
অবহেলা ক’রে আমি দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে,
ঘৃণা ক’রে দেখিয়াছি মেয়েমানুষেরে;
আমারে সে ভালোবাসিয়াছে,
আসিয়াছে কাছে,
উপেক্ষা সে করেছে আমারে,
ঘৃণা ক’রে চ’লে গেছে—যখন ডেকেছি বারে-বারে
ভালোবেসে তারে;
তবুও সাধনা ছিলো একদিন–এই ভালোবাসা;
আমি তার উপেক্ষার ভাষা
আমি তার ঘৃণার আক্রোশ
অবহেলা ক’রে গেছি; যে-নক্ষত্ৰ—নক্ষত্রের দোষ
আমার প্রেমের পথে বার-বার দিয়ে গেছে বাধা
আমি তা’ ভুলিয়া গেছি;
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।
তবু এই ভালোবাসা—ধুলো আর কাদা।
মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয়—প্রেম নয়—কোনো এক বোধ কাজ করে।
আমি সব দেবতারে ছেড়ে
আমার প্রাণের কাছে চ’লে আসি,
বলি আমি এই হৃদয়েরে:
সে কেন জলের মতো ঘুরে-ঘুরে একা কথা কয়!
অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময়?
কোনোদিন ঘুমাবে না? ধীরে শুয়ে থাকিবার স্বাদ
পাবে না কি? পাবে না আহ্লাদ
মানুষের মুখ দেখে কোনোদিন!
মানুষীর মুখ দেখে কোনোদিন!
শিশুদের মুখ দেখে কোনোদিন!
এই বোধ—শুধু এই স্বাদ
পায় সে কি অগাধ—অগাধ!
পৃথিবীর পথ ছেড়ে আকাশের নক্ষত্রের পথ
চায় না সে? করেছে শপথ
দেখিবে সে মানুষের মুখ?
দেখিবে সে মানুষীর মুখ?
দেখিবে সে শিশুদের মুখ?
চোখে কালো শিরার অসুখ,
কানে যেই বধিরতা আছে,
যেই কুঁজ—গলগণ্ড মাংসে ফলিয়াছে
নষ্ট শসা—পচা চাল্কুমড়ার ছাঁচে,
যে-সব হৃদয়ে ফলিয়াছে
—সেই সব।
হাজার দুয়ার ।। স্বদেশ
সেন
না উড়ে থেমেছ পাখি, সমস্তটা
ওড়ো
কিভাবে উড়ছ না তুমি, কী রকম বন্ধ হয়ে আছ
এভাবে পালকে ওড়ো
নানান আকারে একবার
বল্লী বাঁকা, ভরা খোল
গরম রোদের ওই দিকে
মেরুচুম্বকের কোন টানে উঠে পড়ো
হাওয়া খোলা, ওপরে সমস্ত ডানা আনো।
কিভাবে উড়ছ না তুমি, কী রকম বন্ধ হয়ে আছ
এভাবে পালকে ওড়ো
নানান আকারে একবার
বল্লী বাঁকা, ভরা খোল
গরম রোদের ওই দিকে
মেরুচুম্বকের কোন টানে উঠে পড়ো
হাওয়া খোলা, ওপরে সমস্ত ডানা আনো।
একবার ভালোবাসা ভালোবেসেছিলে
সমস্ত সময় থেকে খুলে পড়েছিলে
সঠিক ডাকের তুমি পাখি—
এক পাখি ওড়ো, তুমি আর পাখি,
সমস্ত সময় থেকে খুলে পড়েছিলে
সঠিক ডাকের তুমি পাখি—
এক পাখি ওড়ো, তুমি আর পাখি,
ফিরে
ওড়ো হাজারের দিকে।
বিনির্মাণ
করলেন অলোক বিশ্বাস
যাই বলো
তাই বলো / অলোক বিশ্বাস
যেই না আকাশ রঙ বদলায়
পাল তুলে দিই মন দরিয়ায়
হৃদয় জোড়া ঝড় বাদলে
সুর ছুটেছে প্রাণ মাদলে
যেমন খুশি গাইবো ছড়া
মোহন রসে স্বপ্ন ভরা
আকাশ বাতাস ঝনঝনালি
রামধনুকের রঙ ঘনালি
চালচুলোতে লাগুক ধুলো
দোলায় দুলুক স্বপ্নগুলো
যাদুর খেলায় খেলতে থাকুক
হা করে লোক চমকে উঠুক
এই পৃথিবীর ফোঁস মানি না
কান্না দুখের ভুত জানি না
লিখছি কেবল কল্পিত গান
স্বর্গ মর্ত্য রে কম্পমান
ব্যাকরণে তার নেই সংজ্ঞা
নাইতে নাইতে নিজেই গঙ্গা
হয়েই ছুটছি দেশ বিদেশে
এই ছোটাতে কার কী আসে
যে যার মতো অর্থ করুক
তুলছি রে তান মশায় মারুক
আমার গানের মাতাল ভেলায়
এই পৃথিবী শ্যাওলা ক্যালায়
মৃত্যুকে আজ মারছি চাটি
সূর্য এঁকেই ভয়কে কাটি
অন্ধকারেই ভল্ল ছোটে
কাঁদছো কেন ফুল তো ফোটে
যুদ্ধ বিমান সরি বলছে
ধরায় নেমে প্রেম ঢোলছে
ভোলামনের বাক্য বানে
ধুলো ময়লা ধুচ্ছি প্রাণের
সুর দিয়ে ধুই জগৎ কালো
ভাইরাল হোক সব গানের আলো।
যেই না আকাশ রঙ বদলায়
পাল তুলে দিই মন দরিয়ায়
হৃদয় জোড়া ঝড় বাদলে
সুর ছুটেছে প্রাণ মাদলে
যেমন খুশি গাইবো ছড়া
মোহন রসে স্বপ্ন ভরা
আকাশ বাতাস ঝনঝনালি
রামধনুকের রঙ ঘনালি
চালচুলোতে লাগুক ধুলো
দোলায় দুলুক স্বপ্নগুলো
যাদুর খেলায় খেলতে থাকুক
হা করে লোক চমকে উঠুক
এই পৃথিবীর ফোঁস মানি না
কান্না দুখের ভুত জানি না
লিখছি কেবল কল্পিত গান
স্বর্গ মর্ত্য রে কম্পমান
ব্যাকরণে তার নেই সংজ্ঞা
নাইতে নাইতে নিজেই গঙ্গা
হয়েই ছুটছি দেশ বিদেশে
এই ছোটাতে কার কী আসে
যে যার মতো অর্থ করুক
তুলছি রে তান মশায় মারুক
আমার গানের মাতাল ভেলায়
এই পৃথিবী শ্যাওলা ক্যালায়
মৃত্যুকে আজ মারছি চাটি
সূর্য এঁকেই ভয়কে কাটি
অন্ধকারেই ভল্ল ছোটে
কাঁদছো কেন ফুল তো ফোটে
যুদ্ধ বিমান সরি বলছে
ধরায় নেমে প্রেম ঢোলছে
ভোলামনের বাক্য বানে
ধুলো ময়লা ধুচ্ছি প্রাণের
সুর দিয়ে ধুই জগৎ কালো
ভাইরাল হোক সব গানের আলো।
সূত্র: আবোল –তাবোল ।। সুকুমার রায়
বোধ ।। অলোক বিশ্বাস
এই অস্থিরতা- ভিতরে তাহার অযুত কল্পসার
ইহাই পালতোলা- সারাদিন সর্বত্র সমস্ত প্রক্রিয়ায় !
ইহাই চঞ্চলতা- সে নিবিড়- সে বাঙময়
অনন্ত অনাবিল- সরবতায় নীরবতায়
যখন যেখানে ঘুরি
চাঞ্চল্যের হৃদি, নৌকোর পাটাতনে- হাটে ও বাজারে
অস্থির বসিয়াছে হৃদয়ের ওপরে
সারাবেলা, হৃদয় ব্যাপিয়া তাহার অবিরাম খেলা।
সে খেলায় অন্য সকল নিভে যায়, শুয়ে থাকে
সুশীতল হয়ে, নির্বিকার হয়ে !
মাঠে ঘাটে প্রার্থনায় পরিবারে
সহজ লোকেরা যাহাকিছু
যেভাবে সম্পন্ন করে সহজতররূপে
সেই ভাষা আমিও কি পারি ?
সেই জ্ঞান অন্য কোথাও তুলনীয় হয় ?
ওই যে চালকেরা, পৃথিবীর কতো সব
দায়ভার লয়ে কাহিনিতে পুনঃপুনঃ জন্মে
ছুটিতেছে পথ হতে পথে অন্যতর পথ পানে
কতো কী সম্পন্ন করিতেছে সেই সামাজিক অস্তিত্বগুলি !
নিকেতন ভরিতেছে ততো অর্থের আলোয়
আহ্লাদে প্রতিবাদে পরিণয়ে ভালোবেসে
জেগে থাকে পৃথিবী তাহাদের কর্মের অধিকারে।
অথচ আমি এক প্রাণ ওইসব মহার্ঘ হতে দূরে
শুধু কোনো অসম্ভব অস্থিরতায়
হৃদয় এভাবে কেন পালতোলা
হৃদয় এভাবে কেন চঞ্চল !
পথ পাল্টে পাল্টে চলি
এড়াবার কারণে সকল চঞ্চলতা ।
যেভাবে ঘাসুরিয়া কাটে ঘাস
সেভাবে অস্থিরতাগুলি ছেটে ছেটে ফেলে
আরো আরো নিমগ্ন হই
কর্মের নিগড়ে।
তবু সে আমার অস্থির ব্যঞ্জনা
গভীর গভীরতর শিরা উপশিরায় রক্তমাংসে
নাচে, গান গায় উল্লাস করে !
সে এক কঠিনতর মুদ্রা আমার
আবহমান অসুখের মতোন
এইদিকে ওইদিকে সকল মানুষের ভিড়ে
নিমজ্জিত থেকেও
আমি যেন কোথাও নির্জন সম্পূর্ণত একা হয়ে আছি।
আমিও তো দলবদ্ধ পাখির মাতন
আমিও তো ব্যবহৃত ইট কাঠ পাথরের মতোন
ঘাম ঝরা শ্রমিকের চেতন।
তাহাদের হৃদয়ের দানাপানি রোদছায়া
তাহাদের যাপনের উড়োপাখি ফলমূল
দধিরূপ তিথি আর মিষ্টান্ন পরিবেশন,
সে সকল কর্মশালা সাদৃশ্যে মেলে নাকি
আমারই চলার কথন ?
কেন তালে এভাবে পৃথকত্বে বসে থাকি বারবার ?
এই অস্থিরতা তালে কি মাত্র মুদ্রাদোষ ?
প্রকৃতই পৃথক হতে পারি মানুষের সরবতা থেকে ?
প্রবহমান অভ্যাস হতে আমি এতোই আলাদা !
আমিও তো অন্য সকলের মতো
হয়েছি কর্মরত আষাড় শ্রাবণে ।
লাঙ্গলের ফলা হাতে নেমেছি মাটিতে স্বপ্নময় ।
আমিও তো তোলপাড় হয়েছি
আপাদমস্তক বাস্তবের সংগ্রামী সিলেবাসে।
কতো শীত হেমন্ত প্রবেশ করেছে
স্নায়ুরন্ধ্রের স্তরে স্তরে
কতো জলধারা, পাখি ও প্রতিমার
গন্ধ পেয়েছি আজন্মকাল ।
ব্যাগভর্তি মৌরোলা ও শাপলা সমেত
হেঁটে গেছি সূর্যের আলো হতে
নক্ষত্রের আলোয়।
পুষ্পমন্দ্রিত কোনো কোনো নারীর সীমানায়।
মেছো মেছোনির দেহের তীব্র গন্ধ
আমাতেও মিশে গেছে দীর্ঘ দীর্ঘকাল ।
যাহা কিছু পরমে করিয়াছি আলিঙ্গন
তাহা হতে পুনঃপুনঃ দূর কোনো লোকালয়ে
কখনো বা চলে গেছি
বিশুদ্ধ চঞ্চলতায় ।
উপেক্ষা করেছি যেমন
সহজিয়া বোধে কতোকিছু প্রাণের রতন
উপেক্ষিত হয়েছি তেমন বারবার
শঙ্খশুভ্র নিদারুণ পূর্ণ মুখশ্রী হতে ।
যাহা কিছু ভালবাসার নয়
ভালোবেসে গেছি নিরবধি সেই গতিবিধি।
যাহা কিছু ঘৃণারও নয়
ঘৃণা করে দেখিয়াছি তাহা প্রবল ঔদাস্যে ।
ভালোবাসা, যদিও ভেবেছি জীবনের মুখ্যত ধন,
সেই পথে কেবলই দেখেছি অশ্রুপাত ।
প্রেমধনে ছাইভস্মের পাহাড় পুলকিত হয়ে আছে।
তথাপি প্রেমের যাবতীয় কালিঝুলি ঝেরে
একান্তে চেয়েছি তাহারে অতি নিকটে !
এইসব অমোঘ অনিবার্য
প্রত্যয় থেকে কেবলই সরে গিয়ে
ব্যক্তিগত নির্জনতায় ফিরে ফিরে আসি।
অর্থ নয়, শর্ত নয়, কোনো এক চাঞ্চল্য কাজ করে।
বহু প্রত্যাশিত পণ্য ও পর্ণ
ক্ষণে ক্ষণে আহ্বান করে।
দলে দলে বহু নামে একই ঈশ্বর
তাহাদের মতে মোর মেম্বারশিপ কামনায় ।
আমার এই অস্থিরতার পাবে না কোনো ঘুম
পাবে না চিরন্তন কোনো শান্তি।
এতো এতো আবাল-বৃদ্ধ বনিতার মুখ
তাহাদের আহ্লাদে দুদণ্ড নেবে না আমাকে !
এইসব গণকাকলি কাম ক্রোধ প্রেম ঝিকিমিকি
ভুলি কেবলই
অসীম অস্থিরতায় ঘুরে ঘুরে ঘুরে।
ভাবি নক্ষত্রমালায় চলে যাবো আমি এইভাবে !
ভ্রমিতে কি পারা যায় প্রকৃতই
আপন হতে জেগে ওঠা মানব মানবীর মুখ !
অথবা সেইসব চিরবেদনা,
টুসটুসে পাকা ফসলের ভিতর জেঁকে বসা
পোকামাকড়ের কথা কি ভুলে যায় কেউ !
তবু, সব চিন্তাভার বেদনা ও প্রেমের ভাষা ছেড়ে
পুনঃপুনঃ লিপিত হই একাকিত্বের কাছে ।
এই অস্থিরতা এই চঞ্চলতা একামিতার
কোথাও তুলনারহিত বলে কখনো মনে হয় !
এই অস্থিরতা- ভিতরে তাহার অযুত কল্পসার
ইহাই পালতোলা- সারাদিন সর্বত্র সমস্ত প্রক্রিয়ায় !
ইহাই চঞ্চলতা- সে নিবিড়- সে বাঙময়
অনন্ত অনাবিল- সরবতায় নীরবতায়
যখন যেখানে ঘুরি
চাঞ্চল্যের হৃদি, নৌকোর পাটাতনে- হাটে ও বাজারে
অস্থির বসিয়াছে হৃদয়ের ওপরে
সারাবেলা, হৃদয় ব্যাপিয়া তাহার অবিরাম খেলা।
সে খেলায় অন্য সকল নিভে যায়, শুয়ে থাকে
সুশীতল হয়ে, নির্বিকার হয়ে !
মাঠে ঘাটে প্রার্থনায় পরিবারে
সহজ লোকেরা যাহাকিছু
যেভাবে সম্পন্ন করে সহজতররূপে
সেই ভাষা আমিও কি পারি ?
সেই জ্ঞান অন্য কোথাও তুলনীয় হয় ?
ওই যে চালকেরা, পৃথিবীর কতো সব
দায়ভার লয়ে কাহিনিতে পুনঃপুনঃ জন্মে
ছুটিতেছে পথ হতে পথে অন্যতর পথ পানে
কতো কী সম্পন্ন করিতেছে সেই সামাজিক অস্তিত্বগুলি !
নিকেতন ভরিতেছে ততো অর্থের আলোয়
আহ্লাদে প্রতিবাদে পরিণয়ে ভালোবেসে
জেগে থাকে পৃথিবী তাহাদের কর্মের অধিকারে।
অথচ আমি এক প্রাণ ওইসব মহার্ঘ হতে দূরে
শুধু কোনো অসম্ভব অস্থিরতায়
হৃদয় এভাবে কেন পালতোলা
হৃদয় এভাবে কেন চঞ্চল !
পথ পাল্টে পাল্টে চলি
এড়াবার কারণে সকল চঞ্চলতা ।
যেভাবে ঘাসুরিয়া কাটে ঘাস
সেভাবে অস্থিরতাগুলি ছেটে ছেটে ফেলে
আরো আরো নিমগ্ন হই
কর্মের নিগড়ে।
তবু সে আমার অস্থির ব্যঞ্জনা
গভীর গভীরতর শিরা উপশিরায় রক্তমাংসে
নাচে, গান গায় উল্লাস করে !
সে এক কঠিনতর মুদ্রা আমার
আবহমান অসুখের মতোন
এইদিকে ওইদিকে সকল মানুষের ভিড়ে
নিমজ্জিত থেকেও
আমি যেন কোথাও নির্জন সম্পূর্ণত একা হয়ে আছি।
আমিও তো দলবদ্ধ পাখির মাতন
আমিও তো ব্যবহৃত ইট কাঠ পাথরের মতোন
ঘাম ঝরা শ্রমিকের চেতন।
তাহাদের হৃদয়ের দানাপানি রোদছায়া
তাহাদের যাপনের উড়োপাখি ফলমূল
দধিরূপ তিথি আর মিষ্টান্ন পরিবেশন,
সে সকল কর্মশালা সাদৃশ্যে মেলে নাকি
আমারই চলার কথন ?
কেন তালে এভাবে পৃথকত্বে বসে থাকি বারবার ?
এই অস্থিরতা তালে কি মাত্র মুদ্রাদোষ ?
প্রকৃতই পৃথক হতে পারি মানুষের সরবতা থেকে ?
প্রবহমান অভ্যাস হতে আমি এতোই আলাদা !
আমিও তো অন্য সকলের মতো
হয়েছি কর্মরত আষাড় শ্রাবণে ।
লাঙ্গলের ফলা হাতে নেমেছি মাটিতে স্বপ্নময় ।
আমিও তো তোলপাড় হয়েছি
আপাদমস্তক বাস্তবের সংগ্রামী সিলেবাসে।
কতো শীত হেমন্ত প্রবেশ করেছে
স্নায়ুরন্ধ্রের স্তরে স্তরে
কতো জলধারা, পাখি ও প্রতিমার
গন্ধ পেয়েছি আজন্মকাল ।
ব্যাগভর্তি মৌরোলা ও শাপলা সমেত
হেঁটে গেছি সূর্যের আলো হতে
নক্ষত্রের আলোয়।
পুষ্পমন্দ্রিত কোনো কোনো নারীর সীমানায়।
মেছো মেছোনির দেহের তীব্র গন্ধ
আমাতেও মিশে গেছে দীর্ঘ দীর্ঘকাল ।
যাহা কিছু পরমে করিয়াছি আলিঙ্গন
তাহা হতে পুনঃপুনঃ দূর কোনো লোকালয়ে
কখনো বা চলে গেছি
বিশুদ্ধ চঞ্চলতায় ।
উপেক্ষা করেছি যেমন
সহজিয়া বোধে কতোকিছু প্রাণের রতন
উপেক্ষিত হয়েছি তেমন বারবার
শঙ্খশুভ্র নিদারুণ পূর্ণ মুখশ্রী হতে ।
যাহা কিছু ভালবাসার নয়
ভালোবেসে গেছি নিরবধি সেই গতিবিধি।
যাহা কিছু ঘৃণারও নয়
ঘৃণা করে দেখিয়াছি তাহা প্রবল ঔদাস্যে ।
ভালোবাসা, যদিও ভেবেছি জীবনের মুখ্যত ধন,
সেই পথে কেবলই দেখেছি অশ্রুপাত ।
প্রেমধনে ছাইভস্মের পাহাড় পুলকিত হয়ে আছে।
তথাপি প্রেমের যাবতীয় কালিঝুলি ঝেরে
একান্তে চেয়েছি তাহারে অতি নিকটে !
এইসব অমোঘ অনিবার্য
প্রত্যয় থেকে কেবলই সরে গিয়ে
ব্যক্তিগত নির্জনতায় ফিরে ফিরে আসি।
অর্থ নয়, শর্ত নয়, কোনো এক চাঞ্চল্য কাজ করে।
বহু প্রত্যাশিত পণ্য ও পর্ণ
ক্ষণে ক্ষণে আহ্বান করে।
দলে দলে বহু নামে একই ঈশ্বর
তাহাদের মতে মোর মেম্বারশিপ কামনায় ।
আমার এই অস্থিরতার পাবে না কোনো ঘুম
পাবে না চিরন্তন কোনো শান্তি।
এতো এতো আবাল-বৃদ্ধ বনিতার মুখ
তাহাদের আহ্লাদে দুদণ্ড নেবে না আমাকে !
এইসব গণকাকলি কাম ক্রোধ প্রেম ঝিকিমিকি
ভুলি কেবলই
অসীম অস্থিরতায় ঘুরে ঘুরে ঘুরে।
ভাবি নক্ষত্রমালায় চলে যাবো আমি এইভাবে !
ভ্রমিতে কি পারা যায় প্রকৃতই
আপন হতে জেগে ওঠা মানব মানবীর মুখ !
অথবা সেইসব চিরবেদনা,
টুসটুসে পাকা ফসলের ভিতর জেঁকে বসা
পোকামাকড়ের কথা কি ভুলে যায় কেউ !
তবু, সব চিন্তাভার বেদনা ও প্রেমের ভাষা ছেড়ে
পুনঃপুনঃ লিপিত হই একাকিত্বের কাছে ।
এই অস্থিরতা এই চঞ্চলতা একামিতার
কোথাও তুলনারহিত বলে কখনো মনে হয় !
সূত্র: বোধ ।। জীবনানন্দ দাশ
উড়ান বাহার ।। অলোক বিশ্বাস
এভাবে বসেছো কেন পাখি
বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়
এখনো তো অগণিত পথচারী নিরাসক্ত হৃদয়
উড়ে উড়ে জাগাও তাহাদের ।
অপার মনবীনা বাজায়েছো নানা মোহনায় সংযোগে ।
উড়লেই থেমে যাবে পৃথিবীর কৃত্রিম ।
গরম বাতাসগুলি মোলায়েম করেছিলে
ভালোবেসে স্পর্শ দিয়েছিলে বন্ধ দুয়ারভেদী মন।
পুনরায় ডানা মেলে দিয়ে
মেঘদগ্ধ সূর্যের বাঁধনহারা হৃদি খুলে দাও।
কাল নিরপেক্ষ পাখি তুমি, কেবলই পক্ষী নও।
সমস্ত পালকে ধরেছ আকাশ মৌলিক
হাজারে বিকশিত করো ডানার উড়ান ।
এভাবে বসেছো কেন পাখি
বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়
এখনো তো অগণিত পথচারী নিরাসক্ত হৃদয়
উড়ে উড়ে জাগাও তাহাদের ।
অপার মনবীনা বাজায়েছো নানা মোহনায় সংযোগে ।
উড়লেই থেমে যাবে পৃথিবীর কৃত্রিম ।
গরম বাতাসগুলি মোলায়েম করেছিলে
ভালোবেসে স্পর্শ দিয়েছিলে বন্ধ দুয়ারভেদী মন।
পুনরায় ডানা মেলে দিয়ে
মেঘদগ্ধ সূর্যের বাঁধনহারা হৃদি খুলে দাও।
কাল নিরপেক্ষ পাখি তুমি, কেবলই পক্ষী নও।
সমস্ত পালকে ধরেছ আকাশ মৌলিক
হাজারে বিকশিত করো ডানার উড়ান ।
সূত্র: হাজার দুয়ার ।। স্বদেশ সেন
পারমাণবিক বিনির্মাণ
ইন্দ্রনীল ঘোষ
স্বদেশ সেনের “হাজার দুয়ার”
কবিতাটি যখন বিনির্মাণ করেন অলোক বিশ্বাস, তৈরি
হয় কবিতা “উড়ান বাহার”। আমরা পাশাপাশি দুটো কবিতা
একটু দেখি।
হাজার দুয়ার
/ স্বদেশ সেন
না উড়ে থেমেছ পাখি, সমস্তটা ওড়ো
কিভাবে উড়ছ না তুমি, কী রকম বন্ধ হয়ে আছ এভাবে পালকে ওড়ো নানান আকারে একবার বল্লী বাঁকা, ভরা খোল গরম রোদের ওই দিকে মেরুচুম্বকের কোন টানে উঠে পড়ো হাওয়া খোলা, ওপরে সমস্ত ডানা আনো।
একবার ভালোবাসা ভালোবেসেছিলে
সমস্ত সময় থেকে খুলে পড়েছিলে সঠিক ডাকের তুমি পাখি— এক পাখি ওড়ো, তুমি আর পাখি, ফিরে ওড়ো হাজারের দিকে। |
উড়ান বাহার / অলোক বিশ্বাস
এভাবে বসেছো কেন পাখি
বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়
এখনো তো অগণিত পথচারী নিরাসক্ত হৃদয়
উড়ে উড়ে জাগাও তাহাদের।
অপার মনবীনা বাজায়েছো নানা মোহনায় সংযোগে।
উড়লেই থেমে যাবে পৃথিবীর কৃত্রিম।
গরম বাতাসগুলি মোলায়েম করেছিলে
ভালোবেসে স্পর্শ দিয়েছিলে বন্ধ দুয়ারভেদী মন।
পুনরায় ডানা মেলে দিয়ে
মেঘদগ্ধ সূর্যের বাঁধনহারা হৃদি খুলে দাও।
কাল নিরপেক্ষ পাখি তুমি, কেবলই পক্ষী নও।
সমস্ত পালকে ধরেছ আকাশ মৌলিক
হাজারে বিকশিত করো ডানার উড়ান।
|
পাখি ওড়ার অনুষঙ্গ ঘিরে স্বদেশ সেনের মূল
কবিতাটি — তার থেমে থাকা, না-ওড়ার কারণ, ওড়ার
প্রস্তাবনা ইত্যাদি। সম্ভবত সেই কারণেই, শিরোনামে ওড়ার
প্রসঙ্গ আর ব্যবহার করেননি কবি, নাম দিয়েছেন “হাজার দুয়ার”, যা ইঙ্গিত করে অজস্র খোলা পথের দিকে,
মুক্তির দিকে। বিনির্মাণ করার সময় কবি অলোক বিশ্বাস খুব স্বাভাবিক
ভাবেই কবিতায় সবচেয়ে স্পষ্ট অনুষঙ্গ, পাখি ওড়ার বিষয়টিকেই
প্রথমে পয়েন্ট করেন — নাম দেন “উড়ান
বাহার”। যদিও “উড়ান” সেই
মুক্তির দিকেও নির্দেশ করে।
বিনির্মিত কবিতার প্রথম দুটো লাইন এরকম —
স্বদেশ সেনের না উড়ে থামা পাখির কথা উল্লেখ করছেন কবি, কিন্তু মূল কবিতার সাথে পার্থক্য রাখতে পাখির বসা প্রসঙ্গ। অর্থাৎ সেই না-ওড়া পাখিটার কথাই হলো কিন্তু অন্যভাবে। মজার বিষয়, দ্বিতীয় লাইনে কবি এ-ও বলছেন “বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়”, মানে এমন দেখায় যা উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তা সত্যিই কেমন দেখায় সেটা আর কোথাও বলছেন না, গোটা কবিতায় আর একবারও ব’সে থাকা বা তার ধরণটির উল্লেখ নেই, আছে ওড়ার কথা। কারণ মূল কবিতা পাখির ওড়াকে কেন্দ্র ক’রে এবং বিনির্মিত কবিতাটি মূল কবিতার অনুসারী। সম্ভবত কবি অলোক বিশ্বাস-ও তাই চেয়েছেন। সে কারণেই, “সমস্ত পালকে ধরেছ আকাশ মৌলিক” বা “উড়লেই থেমে যাবে পৃথিবীর কৃত্রিম” এরকম অনন্য ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও কবিতাটিকে অনায়াসেই মূল কবিতার সাথে রিলেট করা যায়। মূল কবিতার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কবিতার মতো সে দাঁড়িয়ে নেই। সেই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠা কাম্য কিনা, তা বিনির্মাণের লক্ষ্য হতে পারে কিনা, বরং দেখা যাক।
“এভাবে
বসেছো কেন পাখি
বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়”।
স্বদেশ সেনের না উড়ে থামা পাখির কথা উল্লেখ করছেন কবি, কিন্তু মূল কবিতার সাথে পার্থক্য রাখতে পাখির বসা প্রসঙ্গ। অর্থাৎ সেই না-ওড়া পাখিটার কথাই হলো কিন্তু অন্যভাবে। মজার বিষয়, দ্বিতীয় লাইনে কবি এ-ও বলছেন “বসে থাকাগুলি কেমনতর দেখায়”, মানে এমন দেখায় যা উল্লেখযোগ্য, কিন্তু তা সত্যিই কেমন দেখায় সেটা আর কোথাও বলছেন না, গোটা কবিতায় আর একবারও ব’সে থাকা বা তার ধরণটির উল্লেখ নেই, আছে ওড়ার কথা। কারণ মূল কবিতা পাখির ওড়াকে কেন্দ্র ক’রে এবং বিনির্মিত কবিতাটি মূল কবিতার অনুসারী। সম্ভবত কবি অলোক বিশ্বাস-ও তাই চেয়েছেন। সে কারণেই, “সমস্ত পালকে ধরেছ আকাশ মৌলিক” বা “উড়লেই থেমে যাবে পৃথিবীর কৃত্রিম” এরকম অনন্য ব্যবহার থাকা সত্ত্বেও কবিতাটিকে অনায়াসেই মূল কবিতার সাথে রিলেট করা যায়। মূল কবিতার থেকে সম্পর্ক ছিন্ন ক’রে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র কবিতার মতো সে দাঁড়িয়ে নেই। সেই স্বতন্ত্র হয়ে ওঠা কাম্য কিনা, তা বিনির্মাণের লক্ষ্য হতে পারে কিনা, বরং দেখা যাক।
কবিতার বিনির্মাণ, অর্থাৎ,
এক গঠিত কবিতার সব গ্রন্থি খুলে পুনরায় তার নির্মাণ — আরেকটি অন্য কবিতার। অনেকে মনে করেন, এ’ এক রকম কবিতার অনুবাদই, শুধু ভাষা অপরিবর্তিত থেকে
গেল। কিন্তু কেন? সাহিত্য যেহেতু ভাষা নির্ভর এক মাধ্যম,
তাই বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছতে অনুবাদ বা ভাষান্তর এখানে
অবশ্য প্রয়োজনীয়। কিন্তু যখন কেউ একই ভাষার মধ্যে থেকে এরকম বিনির্মাণ করতে চান কী
হতে পারে তার কারণ?
অনুবাদ সাহিত্যে, আমরা জানি,
বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় সাহিত্য
অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকটাই বাধা হয়ে দাঁড়ায় দুটো ভাষা-ব্যবস্থার গঠনগত পার্থক্য —
স্বাভাবিক বাক্য দৈর্ঘ্য, ধ্বনি-কাঠামো,
মিথ এগুলো সবই ভাষা থেকে ভাষাতে বদলে যায়। এ’ বাদেও
আরেকটা বড় সমস্যা হলো, বিভিন্ন জাতির জাতিগত অবস্থানের
পার্থক্য — আবেগ, তার প্রকাশ, মূল্যবোধ, সামাজিক-বোধ এসবের পার্থক্য। ভেবে দেখুন,
আলোকখচিত ব্যস্ত নিউ-ইয়র্ক শহর, এক থেকে আরেক
বিল্ডিং-এ ধাতব জ্বালের নেটওয়ার্ক ছড়িয়ে উড়ে যাচ্ছে স্পাইডারম্যান, আর নিচে ছেঁড়া জামা কাপড়ে গা চুলকোতে চুলকোতে কয়েক শ’ ভিখিরি... কখন উড়ন্ত স্পাইড্যারম্যানের পকেট থেকে খুচরো ঝ’রে পড়বে, সে আশায় হাত পেতে। এমনটা হয় না। সাহিত্য
এবং তার ভাষার সাথে সংশ্লিষ্ট জাতিটির মানসিকতা আচরণ যাপন-পদ্ধতি আষ্টেপৃষ্ঠে
জড়িয়ে। আর তাই এত সবকিছুর পর এক ভাষা থেকে আরেক ভাষায় সাহিত্য অনুবাদের কাজটি হয়ে
ওঠে চ্যালেঞ্জিং। অনুবাদক তাঁর পদ্ধতি অনুযায়ী অনুবাদে কতটা মূল লেখা অনুসারী হবেন
তা ঠিক করেন। এক সময়, জাতি, ভাষার
লেখাকে তিনি প্রতিস্থাপিত করেন আরেক সময়, জাতি ও ভাষার
পরিসরে— মূল লেখাটির প্রতি আনুগত্য রেখে।
বিনির্মাণের ক্ষেত্রে কিন্তু এই সমস্যাগুলো
থাকে না। একটাই ভাষার মধ্যে এক কবিতা থেকে আরেক কবিতায় পৌঁছনো— এই ভাষার
পরিসর ধ্রুবক থাকায় বিনির্মাণের সমস্যা ও তা সমাধানের উপায়, কাজ
ও প্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। এটা আগে বোঝা প্রয়োজন বিনির্মাণ নিয়ে কিছু আলোচনার
জন্য। ভাষার নাম যদি এক থেকে যায়, তবে দুটো কবিতার মধ্যে
ভ্যারিয়েবলগুলো ঠিক কী কী হতে পারে? প্রধান দুই ভ্যারিয়েবল
হলো— ১. সময় (দুটো লেখার মধ্যে সময়ের ব্যবধান) এবং ২.
ব্যক্তিসত্তা (দুই লেখকের পৃথক ব্যক্তিসত্তা)।
১. সময় —কোনো এক বিশেষ সময়ে দাঁড়িয়েও যে
কোনো ভাষার মধ্যে দিয়েই নানারকম ভাষা-স্রোত বয়ে চলে। কিন্তু একটা ঠিকঠাক পর্যায়ের
ব্যবধানে মূল ভাষাটাই এত আলাদা হয়ে পড়ে, যে, পুরনো ভাষাটিকে আলমারিতে গুছিয়ে রাখা মায়ের বিয়ের পোকা-কাটা বেনারসি মনে
হয়। এক দিকে যেমন তার প্রতি এক নস্টালজিক গদগদ... অন্যদিকে তেমনই তার
অব্যবহার্যতা। বিশেষ কোনো ব্যবহারের প্রসঙ্গ বাদ দিলে, সাধারণভাবে
সেই প্রাচীন ভাষা আজ আর লেখা বা বলা কিছুতেই চলে না। অনেকেরই মনে প্রশ্ন ওঠে,
এই “চলে না” কেন?
কোনো গাজোয়ারি বা ফতোয়া যে চালানো যাবে না? নাকি?
কী হবে ওইভাবে কিছু লিখলে বা বললে? উত্তর হলো,
বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। আজ থেকে একশ বছর আগের কোনো লেখা পড়ার সময়
আমাদের মাথায় সেই সময়কালটাও থেকে যায়, ফলে পড়তে সমস্যা হয়
না। কিন্তু হঠাতই সেই ভাষা অনুসরণে লিখতে বা বলতে আরম্ভ করলে অ্যলিয়েনেটেড হয়ে
যেতে হবে — একশ বছর আগের পোশাক প’রে
ঘুরলে যেমন। রূপকথায় ঐরাবতের গল্প বিশ্বাস্য হয়ে ওঠে, কিন্তু
তা’ বলে হাতির পিঠে চেপে অফিস যাওয়া যায় না। সময়ের সাথে সাথে
আমাদের যাপন মূল্যবোধ সামাজিক-বোধ এগুলোর বদল হয়। ফলে বদলে যায় ভাষার শরীর। একটা
পর্যায়ের ব্যবধানে, একই জাতি যেন এক ভিন্ন জাতিতে পরিণত হয়।
এবার এই বদলে যাওয়া ভাষা-শরীরের কারণেই অনেকে
বিনির্মাণকে মনে করেন, এক সময়ের ভাষা থেকে আরেক সময়ের
ভাষাতে কবিতাটিকে প্রতিস্থাপন। অর্থাৎ, ধরা যাক একশ বছর আগের
একটি কবিতা — তার ভাব, অনুষঙ্গ,
বক্তব্য ইত্যাদিকে সমসাময়িক ভাষা ও পরিবেশে অনুবাদ করা। মূল লেখাটির
প্রতি এক্ষেত্রে আনুগত্য বজায় রাখতে চান বিনির্মাণকারী।
২. ব্যক্তিসত্তার পার্থক্য — অর্থাৎ,
মূল কবি ও বিনির্মাণকারীর মধ্যে ব্যক্তিসত্তার পার্থক্য। বিশেষত,
সমসাময়িক কোনো কবিতার বিনির্মাণে ভাষার প্রাচীনত্বের প্রশ্ন থাকে না,
এই পার্থক্যই সেখানে মূল হয়ে ওঠে। বিনির্মাণের আধার হয়ে ওঠে। অর্থাৎ,
মূল কবির শৈলী, দৃষ্টিভঙ্গিকে বিনির্মাণকারীর
শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে প্রতিস্থাপন। এক্ষেত্রেও বিনির্মাণে মূল কবিতার বিভিন্ন
অনুষঙ্গ, ভাব, বক্তব্য (যদি থাকে)
এসবের ওপর আনুগত্য রাখা হয়।
কিন্তু কী প্রয়োজন এই আনুগত্যের? ভাষান্তরে
লেখাকে এক ভাষা থেকে অন্য ভাষায় প্রতিস্থাপনের সমস্যাগুলো আমরা জানি। তাতে কিছু
মাত্রায় হলেও, মূল লেখার রস হারিয়ে যায়। বিশেষত, এই সমস্যা আরো বেশি ক’রে দেখা যায় কবিতার ক্ষেত্রে।
সে যেন এমন এক উদ্ভিদ, যাকে মাটি থেকে একবার তুলে অন্য
মাটিতে বসানো মাত্রই মুষড়ে পড়ে তার টান হয়ে থাকা প্রাণের বুননগুলো। তবু ভাষান্তর,
এত সমস্যার পরও, অপরিহার্য। আগেই বলেছি,
সাহিত্য যেহেতু ভাষা নির্ভর এক মাধ্যম, তাই
বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষের কাছে পৌঁছতে অনুবাদের গুরুত্ব এখানে অনস্বীকার্য। কিন্তু
বিনির্মাণের সেরকম কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। তার তাগিদ কেবলমাত্রই শৈল্পিক তাগিদ। তাই
সেক্ষেত্রে মূল লেখার প্রতি কোনো আনুগত্য রাখা কতটা যুক্তিযুক্ত, ভাবা দরকার। কবিতায় কবির মুহূর্তকালীন মনের স্পন্দন ধ্বনি-তরঙ্গের মাধ্যমে
ছড়িয়ে থাকে। তার প্রতিস্থাপন প্রায় অসম্ভব। বাইরের অনুষঙ্গ, প্রসঙ্গ
এসবের আনুগত্য হয়, ভিতরটার হয় না। তাছাড়া দুটো বিষয় —
এক, পাঠক যেখানে মূল লেখাটার থেকে রসাস্বাদনে
সক্ষম, সেখানে এই দ্বিতীয়টির প্রয়োজন কতটা? দুই, অনেকে বলেন, এই লেখাটা
যদি “অমুক লেখক" লিখতেন তবে
কীভাবে লিখতেন সেটা দেখার। সেক্ষেত্রে বিষয়টা কিন্তু সম্পূর্ণভাবে ব্যক্তি-নির্ভর
পরীক্ষা হয়ে যায়, অর্থাৎ একটা লেখা একজন বিশেষ ব্যক্তির
শৈলীতে কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার। সেই ব্যক্তি বা তাঁর শৈলী সম্পর্কে পরিচিতি না
থাকলে ফিকে হয়ে যায় বিনির্মাণের কারণ। সময়কালের সেই পরিসরে যেখানে আমরা লেখাকে
লেখকের নাম বাদ দিয়ে আলোচনার কথা ভাবি, সেখানে শুধুমাত্র
লেখক-কেন্দ্রিক এক পরীক্ষা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, ভাবা উচিত।
কবিতার বিনির্মাণে, তাই,
মূল কবিতার প্রতি আনুগত্য রাখা অমূলক মনে হয়। তার বিভিন্ন ব্যবহার,
অনুষঙ্গ, চিহ্নকে নতুন লেখাতে এনে, মূল লেখার সাথে তার সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা না ক’রে
বরং নির্মাণ করা যায়, পুরোপুরি ভিন্ন এক নতুন লেখার। পুরনো
লেখাটিকে সম্পূর্ণভাবে বিগঠিত ক’রে, তার
শব্দ, শব্দাংশ, ব্যবহার ইত্যাদির টুকরো
দিয়ে তৈরি নতুন এক লেখা। যা আগের লেখার সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পরিবর্তে নিজেকে
স্বতন্ত্রভাবে তুলে ধরবে। পারমাণবিক স্তর থেকে কোনো বস্তুকে বদলে ফেলার মতো।
পুরনোর শরীর থেকে তারই অংশ নিয়ে নতুনের জন্মের মতো।
যখন সুকুমার রায়ের আবোল তাবোল
(বইয়ের শেষ কবিতা) বিনির্মাণ করতে গিয়ে অলোক বিশ্বাস লেখেন-
“আমার গানের মাতাল ভেলায়
এই পৃথিবী শ্যাওলা ক্যালায়”,
মনে হয় এক স্বতন্ত্র কবিতার পাঠে ঢুকছি এবার। কিম্বা, জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতা থেকে যখন নিয়ে আসেন
“তাহাদের হৃদয়ের দানাপানি রোদছায়া
তাহাদের যাপনের উড়োপাখি ফলমূল
দধিরূপ তিথি আর মিষ্টান্ন পরিবেশন”,
চমকে যেতে হয়। কেবলমাত্র, জীবনানন্দীয় ‘তাহাদের’ শব্দটাকে পিভোট ক’রে গ’ড়ে ওঠা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ ও আঙ্গিকের এই গঠন অবাক করে, মনে হয় স্বতন্ত্র কবিতা বুঝি। কিন্তু তবুও বিনির্মাণের গঠনপথে মূল কবিতাগুলোর প্রতি, তাদের ছন্দ, ভাষা, অনুষঙ্গের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন কবি অলোক বিশ্বাস। এক সম্পূর্ণ ভিন্ন কবিতা খুলে দেওয়ার বদলে চেয়েছেন, পুরনো কবিতার সাথে সম্পর্ক-চিহ্ন রেখে যেতে। পারমাণবিক বিনির্মাণ নয়, বরং মূল কবিতারই এক অন্য রূপ হয়ে উঠেছে বিনির্মিত কবিতাগুলি। তাদের কোনো দায় নেই, মূল কবিতার নাম মুছে, স্বতন্ত্র কবিতা হয়ে প্রকাশের। এর ফলে বিনির্মাণের খেলাটি কেবলমাত্র মূল কবির সাথে বিনির্মাণকারী কবির পার্থক্য কিম্বা দুই সময়ের পার্থক্য তুলে ধরার মধ্যেই সীমিত থাকে। সে হারিয়ে ফেলে মূল কবিতার শব্দ নিয়ে অসংখ্য পারমুটেশনের সম্ভাবনা, হাজারো নতুন কবিতা-নির্মাণের সম্ভাবনা।
“আমার গানের মাতাল ভেলায়
এই পৃথিবী শ্যাওলা ক্যালায়”,
মনে হয় এক স্বতন্ত্র কবিতার পাঠে ঢুকছি এবার। কিম্বা, জীবনানন্দের ‘বোধ’ কবিতা থেকে যখন নিয়ে আসেন
“তাহাদের হৃদয়ের দানাপানি রোদছায়া
তাহাদের যাপনের উড়োপাখি ফলমূল
দধিরূপ তিথি আর মিষ্টান্ন পরিবেশন”,
চমকে যেতে হয়। কেবলমাত্র, জীবনানন্দীয় ‘তাহাদের’ শব্দটাকে পিভোট ক’রে গ’ড়ে ওঠা সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ ও আঙ্গিকের এই গঠন অবাক করে, মনে হয় স্বতন্ত্র কবিতা বুঝি। কিন্তু তবুও বিনির্মাণের গঠনপথে মূল কবিতাগুলোর প্রতি, তাদের ছন্দ, ভাষা, অনুষঙ্গের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেছেন কবি অলোক বিশ্বাস। এক সম্পূর্ণ ভিন্ন কবিতা খুলে দেওয়ার বদলে চেয়েছেন, পুরনো কবিতার সাথে সম্পর্ক-চিহ্ন রেখে যেতে। পারমাণবিক বিনির্মাণ নয়, বরং মূল কবিতারই এক অন্য রূপ হয়ে উঠেছে বিনির্মিত কবিতাগুলি। তাদের কোনো দায় নেই, মূল কবিতার নাম মুছে, স্বতন্ত্র কবিতা হয়ে প্রকাশের। এর ফলে বিনির্মাণের খেলাটি কেবলমাত্র মূল কবির সাথে বিনির্মাণকারী কবির পার্থক্য কিম্বা দুই সময়ের পার্থক্য তুলে ধরার মধ্যেই সীমিত থাকে। সে হারিয়ে ফেলে মূল কবিতার শব্দ নিয়ে অসংখ্য পারমুটেশনের সম্ভাবনা, হাজারো নতুন কবিতা-নির্মাণের সম্ভাবনা।