রঞ্জন মৈত্র-র প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা
রালং মনাস্ট্রির পথে ।। ইন্দ্রনীল ঘোষ
ঘুম দেখেই বোঝা যায়, এটা বন্ধুর
ওই তিল, ওই আঙুল
মায় কানপাশাটাও এক
একটা গ্রামের পাশাপাশি
বুদ্ধ ঘুমিয়ে
তার ইন্দ্রিয়গুলো খেলতে খেলতে
ব’খে গেছে অবেলায়
প্রতিটা পালানোর ব্যাকগ্রাউন্ডেই
যদি একটা মিউজিক হতো
ধরো, গানের সাথে পালিয়ে যাচ্ছে রাজকুমার
আর আমরা বলছি - হেরো হেরো
ঘোড়ার পায়ের শব্দ শুনছি
এমনকি ডাইভ দিলাম
সেটা কুড়ানোর জন্য
এভাবেই তো ডিক্শনারি বাড়ে
কথা বাড়ে -
মানুষ ভাষা শেখে
যখন বুদ্ধরা ঘুমোয় ..
জিরাফ ২ ।। ভাস্বতী গোস্বামী
পাঁচিলের ওপর হাঁটলে জিরাফ
রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেও
তারা মাখছি
ভেসলিনে সুর
ছায়াপথে চুপ রাখলাম
আঙুল কেটে গেল
গায়ে এত জ্বর যে ভেসলিন জায়গা পাচ্ছে না
ভালবাসতে বাসতে একটা ঘর
লাল আলো ভাসা ছড়াচ্ছে
রূপোয় কাটলারী
ন্যাপকিন
একটা ভুল ধরলাম
আর খোসা ছাড়ানো সব জিরাফ গ্রাফিত্তি হয়ে গেল
আওকিগাহারা ।। শুভ আঢ্য
যথেচ্ছ ছায়ার পর আমাদের অন্ধকার খাওয়া হয়
আমরা পতঙ্গভুক গাছের মতোই একে অপরের গা থেকে
চেটে পরিষ্কার করি মনোবেদনা, আর চায়ের বাগানে
আমাদেরই লোলুপ চোখ বেল্টের নিচে ঝিকিয়ে ওঠে
সেখানে ছায়ার ওপর বসি, ঘাড়ের বাঁদিকে
পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রিতে বসে মৃত্যু, কথা হয়
পতঙ্গভুক গাছের মতো আমরা মৃত্যুরও মনোবেদনা খাই
চেটে পরিষ্কার করি সাড়ে তেরো বর্গমাইলের
জমানো ক্লোরোফিল, তৈরি করি খাদ্য
যথেচ্ছ ছায়ায় আমরা ভুল বুঝি এমনকী ভুলকেও
আর তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য নিজেদের টাঙিয়ে দিই
কোনও গাছেরই গোড়ায় অন্য কোনও পতঙ্গভুক গাছের জন্য
বিনির্মান করলেন- জয়শীলা গুহবাগচী
নির্বাণ ।। জয়শীলা গুহবাগচী
ইন্দ্রিয়ের বখে যাওয়া দেখতে দেখতে
হেসে ওঠে ঘুম
কলিঙ্গের ধাতব স্বাদে বুদ্ধ লেগে নেই
সময়ের মতো দেখতে লাগছে প্রতিক্রিয়াকে
অথবা সময় বলে কিছু হয় না
কোথায় পালিয়ে যাবে বল?
নীহারিকা হাসে
অণু পরমাণুতে ফেটে পড়ে হাসি
উনি ঘুমোন... উনি হাসেন...
আর আমাদের গভীরে শুকিয়ে যায় আমাদের শব্দ
গুমগুম করে বেজে ওঠে ভয়... ভয়ের মিউজিক
আমরা রোজ কাঞ্চনজঙ্ঘা থেকে পড়ি... পড়ে যাই
কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের থেকে...
সূত্র: রালং মনাস্ট্রির পথে ।। ইন্দ্রনীল ঘোষ
নকশা ।। জয়শীলা গুহবাগচী
তরঙ্গে ভরে উঠছে হাত
যদি এই জিরাফগন্ধ
যদি এই কুকুরপরিমাণ জীবনান্ত
একবার নীল সেঁকে নেয় গলায়
টসটসে বোধগুলো
ব্যথা ব্যথা কাঠামো হয় শুধু
ভরে ওঠে অম্ল
দুধ ঘন হয় গানে
ভাপ ছড়িয়ে পুড়তে থাকে জ্বর
সংজ্ঞা চিরে টেবিলের ছুড়িটি দেখায়
কতখানি আলো থাকে ভুলে
ভুল আঁকাআকি থেকে
যৎসামান্য এগিয়ে যায়
জিরাফের ছায়ায়... সকল জিরাফ ফেলে যেতে
সূত্র: জিরাফ ২ ।। ভাস্বতী গোস্বামী
সুইচড অফ ।। জয়শীলা গুহবাগচী
অন্ধকার বমি করে মুক্ত করছি নিজের বেলুন
তোমার ত্বক , রোম, সুদিন, ডাস্টবিন চাখতে চাখতে
একে অপরের পাচকরসে
নিজেদের বানিয়ে তুলছি
মুখ থেকে মুখে একটু মৃত্যু , একটু অডিও
সেভ হয়ে থাকে
চায়ের গন্ধের ভেতর পারস্পরিক বিষাক্ত সিপ
ছায়া শুনতে শুনতে
স্বাদু, সস ডোবানো টেক্সটগুলি ভারশূন্য...শূন্য
পৃথিবীর গা থেকে গড়িয়ে পড়ে মনোবেদনা
তোমার ভেতর থেকে গড়িয়ে পড় তুমি
খুব ভোরে
যখন উড়তে থাকে সবুজ
এ হাত... সে অনুশোচনার গন্ধ থেকে
আলো ওঠে
মিথ্যেকে ভরে দেয় শিশির
নিজের অন্ত্র গিলতে গিলতে হঠাৎ কখনো
ভিজে ওঠা নিশ্বাসের কর্ডটা এ মেজরে বেজে ওঠে
তারপর কালো হয়ে যায়
সূত্র: আওকিগাহারা ।। শুভ আঢ্য
মনের মাঝে যে গান বাজে
রঞ্জন মৈত্র
নানা প্রতীক ঘিরে রাখে, জড়িয়ে থাকে, আমাদের জীবনকে। জেনেশুনেও আর তাকে প্রতীক মনে হয়না। আতঙ্কে-আনন্দে, ঘামে-হিমে, প্রেম ও প্রেমশূন্যতায় তা আমাদের প্রতিক্রিয়াময় করে তোলে। শব্দও ব্রহ্ম হয়, অব্যর্থ হয় আবার ব্যর্থতার অন্ধকারে মাখামাখি হয়ে কাঁদে এটা জেনেও, যে, সে কারও প্রতীকমাত্র। শান্তি প্রেম সংগ্ৰাম এবং বিষণ্ণতা এই সব বিভিন্ন অনুভব ও ধারণার রেফারাল শব্দগুলি ছাপিয়ে ওঠে মূল সত্ত্বাকে। আমরা আক্রান্ত হই, স্বপ্ন বুনি নতুন জেগে ওঠার অথবা আবিষ্কার করি তোষক বালিশ ছিঁড়ে তূলো উড়ে যাচ্ছে শূন্যের দিকে। আমরা বারেবারে ধুনুরির টংকার হতে চাই। স্পর্শক অনুভূতি থেকে পালিয়ে আশ্রয় চাই প্রতীকের কাছে, বুদ্ধের কাছে। হেমন্তের মাঠ থেকে নবান্নে। মৃত্যু থেকে, অমৃতের কাছে। জয়শিলা থেকে জয়শীলা পর্যন্ত এই আমাদের কাল্পনিক ভ্রমণবৃত্তান্ত।
কোন কবির কবিতাপাঠ বস্তুতই তার অপনা গাঁও-এর পথে প্রান্তরে এক মানসভ্রমণ। চলতে চলতে কবির নাম, কবির মুখ, পরিচয় নিবাস এইসব অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়। কেবল নিজের মুখ মনে পড়ে। দেখা হয় নিজের সঙ্গেই বারেবার। এবং যত কথা তার সাথেই। জয়শীলা গুহবাগচীর লেখা এই তিনটি কবিতা সম্পর্কে আমার কথাবার্তাগুলিও বস্তুত তাই। রঞ্জন এক উল্লেখ মাত্র। অসংখ্য রঞ্জনের এক কমন উল্লেখ। তবু রঞ্জন শব্দে নিজেকেই মনে পড়ে। বারেবার পারস্পরিক জায়গা বদল করে রঞ্জন আর রঞ্জন। কথা এবং প্রতিকথা চালিয়ে যায়। বোঝার চেষ্টা করে পরস্পরের সূক্ষ্ম অনুভূতির জায়গাগুলি। এরপরের লিখিত বাক্যগুলি সেই বোঝাপড়ারই প্রতীকমাত্র।
বেড়াতে গিয়ে যে পাহাড়কে মুখোমুখি পেলে, মুগ্ধ হলে, আর ক্যামেরা খুললে একটি সময়-স্মারকের জন্য, তাকে কী বলে ডাকবে তুমি সত্যিই জান কি! ধাতুময় যে শহর থেকে পালাতে চেয়েছ, মুক্তি চেয়েছ কিছু সময়ের জন্য তাকেই স্মারক্তি দেখাবে বলে ক্লিক ক্লিক করে উঠছ নরম রোদে, সোনাঝরা সন্ধ্যায়। যেন সে-ই শান্তি এবং তার প্রতীক বুদ্ধ। যেন সে-ই কাঞ্চনজঙ্ঘা। তোমার ইন্দ্রিয়রা ছেলেমানুষি খুশিতে ছুটোছুটি করে বুদ্ধ ও কাঞ্চনজঙ্ঘার মধ্যবর্তী উপত্যকায়। আকাশ নামে যাকে ডাকতে চাও, সূর্য তারা মেঘ দিয়ে চিনে নিতে চাও তার সময়-স্বরূপ, প্রকৃত সেই মহাশূন্যের নীচে পাইন দেওদারে ঘেরা আরও এক শূন্যের অস্তিত্ব টের পাও যখন, দেখতে পাও ভাঙা ঘুম ও হিমবাহের ফাঁক দিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে তোমার ঘড়ি, তার পিছু পিছু যাচ্ছে তোমার হাত, আর তারও পিছু পিছু অজস্র কোষ ও জালিকায় গড়া তোমার আপন বুদ্ধটি। যখন রোদ কিংবা জ্যোৎস্নায় মৃত্যু এসে আলতো ছোঁয়া রাখে বরফের গায়ে, বুদ্ধের মগ্নতায়, তোমার মনে হয় নিজেই পড়ে যাচ্ছ সুন্দর থেকে অথবা সুন্দর তোমারই মুক্তিমুখী আকাঙ্ক্ষা থেকে। কী নামে ডাকবে সেই আলোকে, তুমি সত্যিই জান না।
দেখো, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার দীর্ঘতা সবসময়ই শূন্যমুখী। আকাশের দিকে উঠে যাওয়ার পথেই রিন-রিন ক'রে বাজতে থাকে ঘরবাড়ি ঘুড়ি গম্বুজ এবং জিরাফও। যা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, আমাদের অলক্ষ্যে অচেতনায়। জু-ঘরের সবুজ ঘাসে সব প্রাণ ছাড়িয়ে দাঁড়ানো ও হেঁটে বেড়ানো জিরাফ যা স্পর্শসম্ভব, তার মাথার উপর দিয়ে চেতনাসম্ভব ঘুড়িটি ওড়ে। নীচে আমাদের ঘিরে হাসপাতাল ও পাঁচতারা হোটেল, জেলখানা ও লাইব্রেরি, নদী এবং শ্মশানঘাট। কে চিনি তরঙ্গকে! কে গন্ধকে! বেদনাময় কন্ঠনালি পেরিয়ে আলোর দিকে পা চালাতে চায় কে কে? যখন প্রাণের আঁচে গান বলক দিচ্ছে, সর পড়ছে। যখন জ্বর নিজেই পুড়ে যায় জ্বরে। সেই বোধ। প্রতীকের ছায়া যখন প্রতীকের চেয়ে বড় হয়ে কবির ভাবনা ও অভিযান ছাপিয়ে, যখন তুমিই কবি, ভাবো, সব জিরাফকুচি ছাড়িয়ে চলে যেতে থাকছ এক অনির্মিত জিরাফের দিকে। আর পেছনে পড়ে থাকল ডিসেকশন টেবিল ও এক ছুরি, যা কবির চেতনায় সম্প্রসারণের সহায়ক ছিল মাত্র। মাত্র সহায়ক! কী সম্পর্ক ছিল প্রকৃতপক্ষে ছুরিটির সাথে কবিতাটির, চলো জিরাফ থেকে জিরাফে খুঁজে দেখি।
মনে করে দেখো, ক্রিয়ায় এবং বিক্রিয়ায়, যে, আয়নার কাচ অংশে আমাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে আর পারদ অংশে ভাঙচুরের ইতিকথা। মুখোমুখি বসে থাকা আমাদের মধ্যে উদাসীন কাচ, তার ফাঁক দিয়ে বয়ে যায় হাওয়া ধুলো গ্রীষ্ম শীত। শরৎ এবং বসন্ত। কাচ নীরবে লক্ষ্য করে আমাদের রূপকথা নির্মাণ এবং বিনির্মাণ। যেসব কথা চায়ের কাপে, ভাতের থালায় আর নাগরদোলায় বা সমুদ্রে পাহাড়ে জন্ম নেয় তারা আড়াল করে কথার মৃত্যুকে। ঢেউ আর তীব্র হিম বাতাস, অভয়ারণ্য আর হরর ফিল্ম গড়িয়ে পড়ে কোথায় চলে যায় চিপসের প্যাকেটের মত। আমি আমার থেকে বেরিয়ে আর তুমি তোমার থেকে, লক্ষ্য করি দীর্ঘশ্বাসগুলি। কাচকে স্বাস্থ্য দিই, আদর দিই, শিশির কিংবা দখিনা বাতাস। টের পাই পারদ অংশ বড় হচ্ছে, এগিয়ে আসছে। যৌথ আঙুলে সব সুইচ টিপে দিই একটা জীবন্ত সন্ধ্যার জন্য। তখন আমাদের ঘুমও হেসে ওঠে, ভুল পেইন্টিং থেকে ছড়িয়ে পড়ে ভোরের আলো, ভারশূন্য টেক্সটগুলি দীর্ঘ সবুজ বীথি হয়ে যায়। জিরাফ ভাবনাটিই যে প্রকৃত জিরাফ একথা টের পেয়ে একজন কবি মৃত্যু ফেলে এগিয়ে চলে এক আমৃত্যু পরিভ্রমণের দিকে।
জয়শীলা গুহবাগচী-র প্রিয়/পছন্দের কবিতাগুলি
চলা ।। ভাস্কর চক্রবর্তী
এসো, রাস্তায় এসে দাঁড়াই। রাস্তায় কথা হবে।
রাস্তায় আজ নির্জনতা। বাতাস নেই।
ঘরে তিনশো প্রতিভাবানের ফিসফিসানি। কবিতা কি
তিনমিনিটের সাড়ে-তিনমিনিটের কোনো ব্যাপার
ভাবো তুমি? আমার দুটো চোখ জুড়ে
আজ একটা চলা ভেসে উঠছে। কবেকার সেই চলা।
ভেসে উঠছে কবেকার এক ‘না’।
টেবিল থেকে মৃত্যুকে আমি সরিয়ে রেখেছি। মগজটাকে
স্বাধীন রাখতে হবে। গান গাইতে হবে। গানবাজনাগুলো
সব গেল কোথায় ? আমি
কুসংস্কারের ডেলা নই কোনো। নারীবিদ্বেষী নই
রাস্তায় দাঁড়িয়ে আমি কথা বলতে চাই। এসো।
রাস্তায় এসে দাঁড়াই। কথা হবে। আলাপ হবে।
পাতা ঝরে যেদিন
যেদিন পাতাগুলো ঝরে পড়ে, মনে হয়
জীবনে কিছুই বুঝি আর রইল না। একটা
নিঃস্বতার মধ্য দিয়ে চলতে থাকা যেন। একটা মন্থরতা।
আর অন্ধকার হয়ে আসে যেদিন রাস্তাঘাট
আর বৃষ্টির বিশাল ফোঁটাগুলো যেদিন গায়ে এসে লাগে
আমাদের কী করার আছে
আমরা কীই বা আর করতে পোঁটলা পুঁটলি সমেত
ওই আর্তনাদগুলোকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া?
যদি আলো থাকতো ।। স্বদেশ সেন
দিন থাকতো যদি আলো থাকতো
তবু কেউ কি শোকে বসেছে আজ
স’রে গেছে ঢের জামা জুতোর থেকে
সমস্ত জলে বালতি আজো নেমে যাচ্ছে কুয়োর
টিপ্পুনি আর ভালোকে খারাপ করতে পারেনি
আমি-তুমির মতো কিম্বা প্রত্ন-ছায়ার মতো থাকা।
ক’জন হয় সারা দেশের এক
সারা দেশে মধুসূদনের মতো ক’জন হয়
ক’জন জীবনে ঘোরে তার সেরা মেজাজে?
মাধবীলতাকে আমাদের মাধবীলতা বলতে
অনেকেই পারে না।
প্রত্যেকের আলাদা ফুল তো আলাদা প্রজাপতি
লুঙ্গিতে নিজের নিজের চামড়ার দাগ
শহর ভাবলে ভাববে এই তো নিজের শহর
তাহ’লে দিল্লীতে আর ঘর হারাবে না।
আকাশের তারার প্রেম যে নিজেকে চালায়
দু’পয়সার লড়াই বানিয়ার নিজের প্রেম
এখন এইটে দেখো
কত সাধারণ পাখি কি সাধারণ ভাবে
কত দূরে উড়ে যাচ্ছে।
প্রতিযোগিতা ।। শ্যামল সিংহ
কুয়াশার পায়ে টোকা মারতে মারতেই
আমরা পৌঁছে গেছি বইয়ের শেষ পৃষ্ঠায়
শেষ পৃষ্ঠাটি কে পড়বে আগে
তুমি না আমি?
ভাবতে ভাবতেই মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে পড়েছে
কলম
কলমের চাষ কে করেছিল আগে
তুমি না আমি?
কথা ছিল কবিতায় হুইশল ছাড়া আর
কিছুই রাখবো না
তোমার পায়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ
আমার পায়ে আছড়ে পড়ছে ঢেউ
বিনির্মাণ করলেন- রঞ্জন মৈত্র
লেভেল ক্রসিং ছাড়িয়ে ।। রঞ্জন মৈত্র
খোলা দরজা নিয়ে যাচ্ছে শ্রীকাকুলামের দিকে
শূন্যে বাইশ নম্বর বিছানা
বেড়ানোর জামা প্যান্ট বাটার বাইট
মেঝেয় ছ' নম্বর জুতো
মুক্তি শব্দটি থেকে বেরিয়ে আসা শ্রীকাকুলাম
নিয়ে যাচ্ছে খোলা দরজাটিকে
যারা মেঘ ও ঝরাপাতা
যেসব বৈশাখ
ভাবো যত কথা আমরা ভাবিনি
হু-হু করে ছুটছে না-বলা কালো ও হলুদ
আমাদেরই যারা ছ' নম্বর হাইওয়ে
লেভেল ক্রসিং-এ দাঁড়ানো জাগুলিয়ার বাস
জড়ো করব সব
দৌড় ও হেমন্ত
আর শূণ্যে ডানা দেবে আমার বিছানা
ঝরাপাতায় শব্দ করে হেঁটে আসবে স্টেশন ও কবিতা
সূত্র: চলা ।। ভাস্কর চক্রবর্তী
সেই তো তোমার ।। রঞ্জন মৈত্র
আলো এসে গেল
নুন লংকা ছাড়াই একটা কোরাস
বয়ে যায় এ' মোড় থেকে ও' মোড়
পাড়াকে যে মাধবগঞ্জ বলে ডাকো
যে গোয়াবাগান
সেই তো তোমার আলো
এসে গেল সামান্য একটা কড়াই থেকে
টিয়াপাখির খাঁচা থেকে
সতান ও বিতান একখানা মন
ওড়ায় ওড়ায় আর
ভোঁ কাট্টা বলে চেঁচিয়ে ওঠা
সেই তো তোমার আলো
কত সুইচ এসেছে বাজারে
কত খরচ বাঁচানো তার
তারে বলে দিও
পাখির পায়ে বাঁধা চিঠি
সে তো আমারই লেখা
অক্ষরের নোকঝোঁক, লোডশেডিং-এর মায়া
সে লেখা আমারই তো
পড়লে আর আলো হয়ে এলে
উড়লে আর জড়িয়ে ধরলে পাড়াটিকে
সূত্র: যদি আলো থাকত ।। স্বদেশ সেন
গলুইয়ের জীবন ।। রঞ্জন মৈত্র
কাঠে ঘাম লেগে আছে
কুড়ুলে দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাস
পেরেকে স্বপ্ন দুবেলা
আজ এক অজুবা
আগামী পহেলি
মোহনা আছে
ঢেউ লাগে নৌকোয় আর চামড়াতেও
কাঠের জীবন নিয়ে ভেবেছিলাম
তো আলকাতরা আর রঙ
গলুইয়ের জীবন নিয়ে ভেবেছিলাম
তো শস্য এবং দাওয়া
বইঠা ফ'লে উঠেছে
তার হিল্লোল ও মন্দ সমীর
সেদিকেই টোকা পড়ে চামড়ায় রঙএ
অক্ষর আর স্বরগম ওই যাচ্ছে
মৃত্যু পেরিয়ে সমুদ্রের দিকে
সূত্র: প্রতিযোগিতা ।। শ্যামল সিংহ
বিনির্মাণ প্রসঙ্গে
জয়শীলা গুহবাগচী
রেহেল একটি ওয়েবজিন... এইভাবেই শুরু হয়েছিল চিঠিটি । পড়ার পর মনে হল বেশ তো খেলা... কবিতা নিয়ে খেলা। প্রথম ধাপে তিনটি কবিতা পছন্দ করে পাঠাতে হবে, সেটি পাঠানোর পর দ্বিতীয় ধাপে আর একজন কবির পছন্দ করা কবিতার বিনির্মাণ অথবা নতুন নির্মাণ করতে হবে । কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে তাও করে ফেললাম। তৃতীয় ধাপে সবচেয়ে মুশকিল যাত্রাটি শুরু হল আমার জন্য। এবার অপর এক কবির বিনির্মিত কবিতা আলোচনা করতে হবে । সাহিত্য নিয়ে পড়েও এই আলোচনা বিষয়টি আমার ধাতস্থ হয়নি। কারণ প্রথমেই যেটা মনে হত, আলোচনা করার জন্য এত চুলচেরা পড়াশোনা বোধহয় আমি করিনি। বাংলা সাহিত্যে সামান্য কয়েকজন ছাড়া সঠিক সমালোচক কেই বা আছেন , যাকে অনুসরণ করে বাংলা সাহিত্যের এই ধারাটি পুষ্ট হবে । আলোচনার জন্য যার বিনির্মিত কবিতা আমাকে দেওয়া হল তাকে আমি তাঁর শক্তিশালী কলমের জন্য ভালোবাসি এবং ভয় পাই এবং সমঝে চলি, তিনি রঞ্জন মৈত্র । আর যার কবিতা তিনি বিনির্মিত করেছেন তিনি ভাস্কর চক্রবর্তী ।
নানা কবিতা পড়তে পড়তে নিজের সীমিত ভাবনার জগতে কয়েকটি কবিতা ভালো লেগে যায় কিছুটা বেশী। একটি কবিতার বই এর ভেতর কবির অনেক ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে, তার মধ্যে একটি বা দুটি ভাবনা পেড়ে ফেলে আমাকে , সাথে নিয়ে চলতে থাকে । অথবা ব্যাপারটা হয়তো এমন যে আমি আগে থেকেই তাড়িত হই অমুক ভাবনার দ্বারা। সেই ভাবনাটির সার্থক রুপ খুঁজে পেলে উল্লসিত হই। সব কবির ক্ষেত্রে এমন পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজ করে না যদিও। কারণ তাঁরা প্রত্যেক লাইনে অথবা শব্দে নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি দাঁড় করান । সময়ের নানা মাত্রা যেমন হতবুদ্ধি করে আমাদের তেমনি এইসব কবিতা যাত্রা । তখন ল্যাটারাল থিংকিং সাহায্য করে কবিতার কাছে পৌঁছতে ।ভাস্কর চক্রবর্তীর কবিতা পড়ি মাঝে মধ্যেই, হঠাত “চলা” কবিতাটি পড়ে একরকম বয়ে গিয়েছিলাম। তার কারণ হল এর ভিশন । একটা সময় কবির কাছে সত্যের জগত মিথ্যের জগত বলে কিছু হয় না । কবি একটি অন্তর্চেতনার দ্বারা বিশ্বসংসারকে অনুভব করেন । সামাজিক বা মিথিক্যাল কোন বোধ তাকে চালিত করে না। তিনি তার অস্তিত্বকে খুঁজে পান তাঁর নিজস্ব ভিশনের সহায়তায় । সেই ভিশন তাকে অপার আনন্দ দেয় । তাকে কবিতা দেয় । বস্তু জগতের সঙ্গে স্থাপন করেন তার নিজস্ব দেয়ানেয়ার সম্পর্ক । সে সম্পর্ক একেবারেই ইউনিক। প্রত্যেক বোধ নতুন থেকে নতুনতর মাত্রা যোগ করে শব্দে ।
ভাস্কর চক্রবর্তীর এই কবিতাটি পড়তে গিয়ে মাঝখান থেকে আবার শুরুতে চলে গেলাম...শেষ পর্যন্ত এসে আবার চলা শুরু করতে হল। কবিতায় একটি দুটি লাইন এমন থাকে যে তারা ঘাড় ধরে কবিতা বার বার পড়তে বলে । কবিতার জীবন নাকি জীবনের কবিতা নাকি ওই চলাটুকু। একটু ঘাড় ফিরিয়ে দাঁড়ানো, দুটো কথা রেখে যাওয়া , অথবা না রাখা কিছু বোধ । এত সোজা হলে , এত পয়ার ত্রিপদী জীবন হলে , আকাশ বাতাসে হেলান দিয়ে কাটতো সৌখিন । তাহলে রাষ্ট্রবিদ্বেষ , নারীবিদ্বেষ, সংস্কার , কুসংস্কার কিছুই ঘটতো না।
কবিতার শেষে আর্তনাদ থেকে আবার শুরু হয় ভাবনা । এই নির্মাণের খুব বেশী অভিমুখ নেই । কিন্তু চিৎকারগুলো কোন চিৎকার না রেখেই একটা চিরন্তন চলা হয়ে উঠেছে । এই চলা কখনো আবেগে কেঁপে উঠছে, কখনো রক্ত ঝরাচ্ছে যন্ত্রণার উৎসে । কিন্তু সবই নরম হয়ে আসে…
“আমাদের আর কী করার আছে…
… ওই আর্তনাদগুলোকে একটু সান্ত্বনা দেওয়া ছাড়া?”
রঞ্জন মৈত্র ‘চলা’ কবিতাটির বিনির্মাণ করেছেন । বিনির্মিত কবিতাটির নাম ‘লেভেল ক্রসিং ছাড়িয়ে’ । ‘চলা’ কবিতায় ভার্টিক্যাল থিংকিং-এর যে সিঁড়িটি বেয়ে আমরা জীবনের পোঁটলা পুঁটলি গুলি আগলে রাখার কথা ভাবি , রঞ্জন দা সেই অভিমুখকে আক্রমণ করেছেন, খুলে রেখেছেন চিন্তার বহুমুখিতা, মুক্তি তাই একটা নামের প্রতীক । যে নাম পাঠক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতার বাইরে । আমি শ্রীকাকুলামে যাইনি। তাই আমার জার্নি এক্ষেত্রে একটা নামের দিকে, যাকে আমি যা খুশি চেহারায় ভাবতে পারি। সেখানে আমি শূন্য বিছানায় শুতে পারি অথবা মর্নিং ওয়াকে যেতে পারি। এই স্বাধীনতা আমি একটা শব্দ থেকে পেলাম। কবিতাটি আমাদের জার্নিকে আরো অনির্দেশে নিয়ে গেল। এইভাবে নানাদিক থেকে পর্যবেক্ষণ করে, জীবনের মিথকে ভেঙে কবিতাটি বলছে ‘ ভাবো যত কথা আমরা ভাবিনি’ । জীবনের দুটো পিঠ হয় না, তার অনেক সাইড । সেইসব খেলা ,ল্যাটারাল থিংকিং যেন ‘মুক্তি শব্দটি থেকে বেরিয়ে আসা শ্রীকাকুলাম’ । মুক্তি থেকে জন্ম হচ্ছে একটি অজানা অভিজ্ঞতার , অথবা একটি অজানা অভিজ্ঞতা জন্ম দিচ্ছে মুক্তি নামে একটি বোধের ।
কীভাবে অভিজ্ঞতাকে নির্মাণ করব আমরা , আমি নিজের কাছে নিজেই একটি অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারি । সেইসব অন্তর্গত অভিজ্ঞতা চাখতে চাখতে যেসব কবিতা নির্মাণ সম্ভব কবি শ্যামল সিংহের কবিতা পাঠ তেমনি এক রাস্তার দিক দেখায় । জীবনের ফ্যাক্টকে আমরা মিস্টিসিজম বলি না । আমার অভিজ্ঞতা নির্মাণ সত্যিই কি তোমার কাছে স্বাভাবিক? নাকি তোমার গলিপথ আমার খুব চেনা ? যে চাঁদে যাবার কথা ভাবে তাকে আমি খোঁড়া ভাবতেই পারি। তাই আমাদের সমতল যেমনই হোক তা একএকটি শ্যামল সিংহের কবিতা , মিস্টিক । কবিতার কাছে কী খুঁজি আমরা ? কবি কী রেখে যান শেষ অবধি? বক্তব্য , প্রপাগান্ডা , বিষয়, অনুভব নাকি কিছুই না… একটা বাঁশির সুর শুধু… একটা ধ্বনি … নাকি তাও না । শ্যামল সিংহের এই কবিতাটি রাখতে চায় কিছু ঢেউ, আর কিছু সুর ।
এহেন একটি কবিতা বিনির্মাণ করেছেন রঞ্জন দা।অসম্ভব দক্ষতা এবং শক্তিশালী মস্তিষ্ক ছাড়া এ কাজটি করা একরকম অসাধ্য ছিল ।সংহত কবিতার সংহতি কে প্রায় এক রেখে কবিতার ভাষা ব্যবহার বদলে দিয়েছেন । কিছু ডায়াক্রোনিক শব্দের ব্যবহার কবিতাকে ব্যপ্তি দিয়েছে, । রঞ্জন দা লিখেছেন কাঠের ঘাম, কুড়ুলে দীর্ঘ শ্বাস, পেরেকে স্বপ্ন… এইসবে গলুইএর জীবন সাধারণ সূত্র ছেড়ে পাড়ি জমায় অচেতন নৌকোয়, ক্রমশ চেতনা ছেড়ে ভেসে যায় । আস্তে আস্তে বৈঠা ফলে , নিজের ভেতর নিজের ফলন হয় । ছোট ছোট ঢেউয়ে কবিতা ভাসতে থাকে । কতভাবে পড়া যায় কবিতাকে । প্রত্যেকটি পাঠ যেন আলাদা আলাদা হয়ে ওঠে । কখনো চেনা কবিতা ভয়ানক অচেনা মনে হয় । কখনো অপূর্ব বোধে কবিকে উল্লাস জানাতে ইচ্ছে করে, কখনো নিভৃতে আকাশ লুকনোর মতো একটি কবিতা আশ্চর্য সন্ধের মতো নেভে জ্বলে । তাকে দেখায় মৃত্যুর মতো অথবা মায়ের মতো ।
এরপর কবি স্বদেশ সেনের একটি কবিতা বিনির্মিত হয়েছে। স্বদেশ সেন কে পড়া আমার কখনো শেষ হয় না । শেষ হবার কথাও নয় । স্বদেশ সেনের কিছু কথা পড়া যাক , -“কবিতার মূল উদ্দেশ্য বোধহয় জীবজগতের এবং ভাষার লুকোনো বা অপরিচিত সত্য ও সৌন্দর্যকে তাড়না করে স্পষ্ট করে তোলা। শব্দবন্ধ যেন কোন অলৌকিকতায় এক নিত্যকালীন অনুভবকে ধরে রাখে , যাকে Primordial বলা যায়”। যিনি এইভাবে কবিতাকে চিন্তা করেন, তার কবিতা সবসময় নতুন হতে বাধ্য । শব্দ তাঁর কাছে পুরনো নয়। যেকোন শব্দকে ব্যবহারের গুণে নতুন করে তুলেছেন । পুরনো শব্দকে এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যাতে ‘বাক্যবন্ধের আবহাওয়া’ পালটে যায় । এইভাবেই লেখা হয়েছে তাঁর কবিতা । তরুণ কবিরা তাকে পড়ছেন মনোযোগ দিয়ে । ২০১৮ সালের বইমেলাতে তাঁর কবিতার সংকলন ‘আপেল ঘুমিয়ে আছে’ বইটির তুমুল চাহিদা দেখে অবাক হয়েছিলাম । প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা কবিরা কী উজ্জ্বল উৎসাহে খুঁজছে বইটি, না পেলে হতাশ হচ্ছে । ‘যদি আলো থাকতো’ কবিতাটি নানা দিক থেকে ভাবনা খুলে রাখে । নিজেদের চিনতে চাওয়ার জন্য যেসব দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমাগত অন্তর্যাত্রা করে তারা সরে যায় জামা জুতোর থেকে । মাধবীলতাকে মাধবীলতা বলা সহজ নয়, সহজ নয় অনেক কিছু । যেহেতু প্রত্যেকের ফুল, প্রজাপতি আলাদা, নিজের চামড়ার দাগ সবাই চিনে রাখে , বানিয়ার বাঁচা নয় , কত সাধারণ পাখি সাধারণ ভাবে উড়ে চলে যায় ।
এই কবিতাটির বিনির্মান করলেন রঞ্জন দা । ভাষা এবং প্যাটার্ন বদলে, ভেঙ্গে দেওয়া গেলো কবিতার স্বস্তিকে । অস্বস্তির নুন লংকা ধীরে ধীরে মাধব গঞ্জে মিশে যায় । কোথাও ঝপ করে সমুদ্র এসে ঢোকে উঠোনে । গোয়াবাগানে কেউ গেয়ে ওঠে ‘সেই তো তোমার আলো’ ।অন্ধকার থেকে গড়িয়ে নামা আলোতে জীবনের গন্ধ, ভেসে থাকে হাল্কা গোয়াবাগান । সতান বিতান মন চেঁচিয়ে ওঠে ভোঁ কাট্টা । যতই খরচ বাঁচাও ভোঁ কাট্টা হবেই । চিঠি আসে জীবনজুড়ে , চিঠি লিখছে অক্ষর, অক্ষর মানে ফোঁটা ফোঁটা আমি। সাবজেক্ট এবং অবজেক্ট কে আলাদা রাখার কথা স্বদেশ সেন বলেছেন । তবু একে অপরের গুণ বয়ে নিয়ে যায় । যেভাবে জীবন জড়িয়ে যায় ধারণায় । টলটলে আয়ুর মতো কবিতা ভাসে। বিনির্মিত কবিতা, আমার কবিতা হয়ে দিনমান এলোমেলো করে , অপূর্ব এই পাঠ অভিজ্ঞতা । রঞ্জন দা জিন্দাবাদ।