বাক্সবদল-৫





নির্বাচিত দুই কবি, একটি জুটি। বেছে নিলেন প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা। বদলে দেওয়া হল বাক্স।
একে অন্যের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণ করলেন। আবার বাক্সবদল।
নিজের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণের আলোচনা করলেন কবি-জোড়।

কৌশিক চক্রবর্তী-র প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা

পারদ / জমিল সৈয়দ

নিচে নেমে আসছে পারদ; মাইনাস-এ নেমে এলে – শুধু চোখের রশ্মি ফেলে
আর কি গর্ভবতী করা যাবে কিশোরীকে !
রক্তও কি ততোধিক উষ্ণ থাকবে –
যাতে দাউদাউ ক’রে জ্বলতে পারে হাত-পা-করোটি ! জিভ চিরে দু’ফাঁক হ’তে
আর কতো দেরি ? গ্রাফাইট থেকে চেঁছে বের ক’রে আনা তেতো ছাই –
বিষ হয়ে ঝরছে হাসিতে ; তাই ঠোঁট ঠেলে বেরিয়ে আসা কথা –
অ্যাতো কুৎসিত !
এমন কুস্বপ্নে ভরা রাত ! নদীতে ভাসাতে চলেছি চলেছি ঝুড়ি –
ভেতরে শায়িত ক’ড়ে আঙুলের মতো ছোটো শিশু –
ঘৃণায় কুঁকড়ে চিৎকার ক’রে শাপ দিচ্ছে – বন্ধ্যা হ’, বন্ধ্যা হ’ !


এইসব অক্ষরের জন্য / শঙ্করনাথ চক্রবর্তী

প্রিয় অক্ষরগুলিকে একদিন কার্পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে জল বাতাস
শষ্যের খোঁজে আমি অলিগলি রাঁড়পল্লী পার হয়ে মলিদাচূর্ণ
ও গেরোবাজ হায়না, ঢুকে পড়েছি আবহমান কোনো গাঁজার আড্ডায় –
শ্রীমৎ দোম আন্তোনিও ও কতিপয় ছেঁড়া ব্রাহ্মণের সঙ্গে অতঃপর
ফাটা মাছ, অর্কবীজ, যোনিমনস্কতা বিষয়ে আলাপ শুরু হয়েছে
আমার...
ফেরার পথে জল বাতাস শষ্যের বদলে ঘাড়ে চেপে দিব্যি ব’ইয়ে
আনছি মর্কটরক্ষিতার সতীচ্ছদ, উইদষ্ট পিতৃপুরুষাঙ্গ ;

এইসব অক্ষরের জন্য এবার শুধু বারুদবমি, শনির থানের সিঁদুর,
রাজকীয় ঘাম আর ভ্রূনিতম্বের গমপেষাই যন্ত্র – 


নভেম্বর ১৯৮২ / দেবাশিস্‌ তরফদার

ডানপাশে নদী আর বাঁপাশে ডাক্তারবাড়ী

এরকমই কেটেছে, কাটছে দিন

এপাশে সব্‌জি নিয়ে নৌকো যায়
ওপাশে ব্যান্ডেজ

কাদামাখা পায়েও পড়েছে রোদ,
মাছিগুলির পাখায়...

রোদে আর নর্দমার অন্ধকারে
এভাবেই হয়েছে মেশামেশি

এই রোদে মাছি ও পায়রা ওড়ে
পাশাপাশি

এভাবেই কাটছে, কাটবে...

একদিকে মর্নিং স্কুল
অন্যদিকে ভয়ংকর জেল...


বিনির্মাণ করলেন সজল দাস

বিনির্মাণ-১ ।। সজল দাস

|| কিশোরীকে ||

জলের পর কাউকে ভাসানো যায়নি
শুধু বরফ
নাবিকের চিৎকার নিয়ে এতদূর এলো

ভাঙা কিশোরী
আর দুলে উঠলে নৌকা ভাবো
হাওয়ার দূ্রত্বে সব কৃষকই মাঝি
ফসল ঝরে গেলে
হালকা লাঙল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মোহনার দিকে

|| শিশু ||

আবাদের পর ফসলও তো শিশু
ডুবে গেলে একা হয়ে যায় দাঁড়

কৃষকের তৃষ্ণা নিয়ে
যে ছবি এতদিন
মাঝির বৌ তাতে হাত রাখে

দূর কোনো বনে
অসময়ে বৃষ্টি হয়
যার কাঠ দিয়ে ফুটো কোনো নৌকা বানানো হবে

সূত্র: পারদ | জমিল সৈয়দ


বিনির্মাণ-২ ।। সজল দাস

গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ
যেন স্তনের মনখারাপ
যে বালি বাতাসে ওড়ে
ঢেউ তাকেই আবার শান্ত করে দেয়

লিখতে লিখতে মানুষ
একদিন শব্দের কাছে পৌঁছে যায়
শব্দের ঘরবাড়ি জানলা-দরজার মধ্যে ঢুকে
পেরে আনে একেকটা আসবাব
পেরেক পোঁতার হাতুড়ি
ও অদ্ভুত সব তালা

একদিন ঝড় আসে
ভাঙা শব্দের ভিতর ভাঙা একটি সাইকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়

একদিন লেখা ফিরে আসে নিজের রাস্তায়
অন্ধকারে মনে হয় ঢেউ

শুধু বালির দাগ
অযথাই লিখে রাখছে কেউ

কথা বলতে পারে না বলে
অন্ধ এক নাবিক
নিজের ফুটো নৌকাকে একাই যেতে দিল আকাশে

এরপর বৃষ্টি আসবে
নাবিক ভাববে, দাঁড়টাকে রেখে দিলেই ভালো হত

বিষন্ন বলেই যে আপেল আমার নয়
তার গাছকে আমি ভালোবেসেছিলাম
অদ্ভুত তার শাখায় হামাগুড়ি দিয়ে উঠে
কথা বলেছিলাম, যে ভাষায় কথা বলার নয়
অথচ বিষন্ন বলে আপেল আমায় চিনতে পারল না
পাতার মধ্যে আশ্চর্যভাবে লুকিয়ে থাকল অনেক্ষণ

গাছ দুঃখী হলে মানুষ কুঠার নিয়ে বেড়াতে যায়
দুঃখের বনে সব মানুষই আসলে জল

সূত্র: এইসব অক্ষরের জন্য | শঙ্করনাথ চক্রবর্তী


বিনির্মাণ-৩ ।। সজল দাস

কেন যে রুদ্ধ এই দেহ
শাসন পেরিয়ে ছোট
ছেলের মত হাত পা
অনন্ত কেশর আর ঘুড়ি নিয়ে
শুধু ছাদ থেকে ছাদে
একা বখে যাওয়া জামাকাপড়
কাকে লেখ তুমি
এত যে জল লেখ, বরফ
তারা সব কোথায় যায়
নাকি স্রেফ ভেঙে গিয়েছিল বলে
কাচ দিয়ে বানালে ঘর
এবার? থাকতে পারবে তো
রক্তে ভেজা এসব আয়না
আর ক্ষয়িষ্ণু সব পাথর পাশাপাশি রেখে
একা থাকতে পারবে তো বালির শহরে!

ছেলেমানুষ বলে ক্ষমা হয়েছিল ঘড়ি
ভাঙার পর সব ঘরই ঠিক
রঙের ভিতর এক বিকেলে
ভেসে থাকতে দেখেছিলাম বুদবুদ
জীবনের মত আশ্চর্য আর বায়বীয় ছায়া পড়েছিল তাতে

সমুদ্র দূরে রেখে যে হেঁটে গেছে ঝাউবনের দিকে
সে ঢেউয়ের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী

আর কাঠের অনন্ত নিঃশ্বাস ভেঙে ফেলেছে গতজন্মের আলনা

সূত্র: নভেম্বর ১৯৮২ | দেবাশিস্‌ তরফদার


বিনির্মাণ প্রসঙ্গে
কৌশিক চক্রবর্তী

       কোনো এক গদ্যে একবার লিখেছিলাম - কবিতার মৃত্যু নেই, শুধু পুনর্জন্ম আছে। এ কথা বিশ্বাস করি বলেই একবার নয়, বারবার লিখতে ইচ্ছে করে। কীভাবে পুনর্জন্ম হয় কবিতার? কেবলই কি অনেক অনেক বছর পর কোনো ক্ষয়ে যাওয়া মলাটের ছোটপত্রিকার পৃষ্ঠা থেকে পাঠকের সামনে সেই কবিতা জেগে ওঠে কোনো এক বিষণ্ণ দুপুরে? হয়ত নয়। হয়ত বা, কবিতার পুনর্জন্ম তখনও হয়, যখন এক কবির এক কবিতা আরেক কবিকে দিয়ে আরেক কবিতা লিখিয়ে নেয়। এই লিখিয়ে নেওয়ার আলোছায়াই বা কীভাবে ঘটে? তা কি আচমকা আসে? তা কি সচেতনভাবে ঘটে? কবিতার অনন্ত সম্ভাবনার মতনই, এই সব প্রশ্নের উত্তর নানা দিকে নিয়ে যায়। হয়ত বা, কবিতার মতনই, সেই সব নানা রাস্তা নতুনের চিঠি নিয়ে আসে।

ধরা যাক জমিল সৈয়দেরপারদকবিতাটির একটা অংশ...

          “নিচে নেমে আসছে পারদ; মাইনাস-এ নেমে এলেশুধু চোখের রশ্মি ফেলে
          আর কি গর্ভবতী করা যাবে কিশোরীকে!
                                         রক্তও কি ততোধিক উষ্ণ থাকবে
          যাতে দাউদাউ করে জ্বলতে পারে হাত-পা-করোটি! জিভ চিরে দুফাঁক হতে
          আর কতো দেরি?...”

       এ কবিতায় এক চিত্রকল্প আছে। কিন্তু তার সঙ্গে আর যা আছে, তা হলো এক হাহাকার। এক অন্ধকার রাত্রির ভয়াল হাহাকার। করালবদনী কালো রাত্রির হাহাকার। এই কবিতার বিনির্মাণ করেছেন তরুণ কবি সজল দাস। সজলের সঙ্গে আমার মুখোমুখি পরিচয় হওয়ার সৌভাগ্য হয়ে ওঠেনি আজও। সেই অপরিচয়ের দুঃখ মিটে যায়, যখন সজল তার কবিতায় ছুঁয়ে যান আমাদের মতন পাঠকদের। সজলের করা এইপারদকবিতার বিনির্মাণ দু-অংশে। বা, এভাবে বলা যাক, অগ্রজ এক কবির একটি কবিতা প্রায় তিরিশ-চল্লিশ বছর পর এক তরুণ কবিকে দিয়ে দুটো কবিতা লিখিয়ে নিয়েছে।

প্রথম কবিতাকিশোরীকে”, যেখানে তিনি বলছেন
                             “জলের পর কাউকে ভাসানো যায়নি
                             শুধু বরফ
                             নাবিকের চিৎকার নিয়ে এতদূর এলো

                             ভাঙা কিশোরী
                             আর দুলে উঠলে নৌকা ভাবো
                             হাওয়ার দূ্রত্বে সব কৃষকই মাঝি
                             ফসল ঝরে গেলে
                             হালকা লাঙল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মোহনার দিকে

       এ কবিতাতেও দুঃখ আছে, আছে তীব্র এক বেদনাবোধ। হাহাকার নেই। অন্ধকার রাত্রির বিহ্বলতা নেই। কিন্তু যেন বা আছে এক ধু ধু করা সাদা কুয়াশায় ঘিরে থাকা বিষণ্ণতা। সুপ্রভাত বিষণ্ণতা।
যে কারনে, সজলের এই বিনির্মাণ পাঠককে এলোমেলো করে দেয়। বিশেষত, যখন তিনি লেখেন

                             “হাওয়ার দূ্রত্বে সব কৃষকই মাঝি
                             ফসল ঝরে গেলে
                             হালকা লাঙল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে মোহনার দিকে

       এই ভেসে যাওয়ার মধ্যে অনেকখানি যাওয়া মিশে আছে। চলে যাওয়া। আর যা কিছু যায়, তাকে আমরাস্মৃতিনাম দিই। সজলের স্মৃতি তাই কিশোরী নাম নিয়ে আমাদের মনকেমন করিয়ে দেয়।

       বলা বাহুল্য, সজলের সময় বা পারিপার্শ্বিক আলাদা হওয়ার কারনে, সজলের মন ও ভাবনা আলাদা হওয়ার কারণে, সজল নিজে অনেক অনেকখানি আলাদা হওয়ার কারণে, তার এই বিনির্মাণ জমিল সৈয়দের কবিতার পাশাপাশি স্বমহিমায় বসে থাকা স্বতন্ত্র নির্মাণ হয়ে উঠেছে।

       আবার সজলের দ্বিতীয় কবিতাশিশু”– সে-ও তো জমিল সৈয়দেরপারদকবিতারই সহযাত্রী। জমিল লিখেছিলেন

                          এমন কুস্বপ্নে ভরা রাত ! নদীতে ভাসাতে চলেছি চলেছি ঝুড়ি
                          ভেতরে শায়িত কড়ে আঙুলের মতো ছোটো শিশু
                          ঘৃণায় কুঁকড়ে চিৎকার করে শাপ দিচ্ছে বন্ধ্যা হ’, বন্ধ্যা হ’!"

       এ কবিতার যে যন্ত্রণা, তার পাশে সজল কী আশ্চর্য এক নীরব বেদনার ঐশ্বর্য এনে রাখলেন। আমরা দেখলাম, এক কুয়াশা ভরা ভোরে দুঃখ যেন আমাদের সামনে দিয়েই হেঁটে গেল। তাকে দেখলাম। ধরার চেষ্টা করলাম না। আর হয়ত বা তাই, সজল দাসের হাত ধরে সে-ও লিখে রেখে গেল

                             “আবাদের পর ফসলও তো শিশু
                             ডুবে গেলে একা হয়ে যায় দাঁড়
                             .........
                             দূর কোনো বনে
                             অসময়ে বৃষ্টি হয়
                             যার কাঠ দিয়ে ফুটো কোনো নৌকা বানানো হবে

       এ কবিতা পাঠককে চুপ করে বসিয়ে রাখে। পাঠক যেন বা এক নীল নীরবতায় দুঃখকে জড়িয়ে ধরে খানিকটা কেঁদে নিতেও পারে।  

       শব্দের জন্যে, কবিতার জন্যে, এই যে উদ্‌ভ্রান্তের মতন ঘুরে ঘুরে বেড়ানো, এই কি তবে কবির ভবিতব্য? ক্ষ্যাপা খুঁজে খুঁজে ফেরে পরশপাথর? এই কি সেই ফুটো নৌকো যার কথা সজল বলেন তার শিশু নামের বিনির্মাণে? শব্দের খোঁজে কবি শঙ্করনাথ চক্রবর্তী তাঁরএইসব অক্ষরের জন্যকবিতায় লেখেন:

                       “প্রিয় অক্ষরগুলিকে একদিন কার্পেটের ওপর শুইয়ে দিয়ে জল বাতাস
                       শষ্যের খোঁজে আমি অলিগলি রাঁঢ়পল্লী পার হয়ে মলিদাচূর্ণ
                       ও গেরোবাজ হায়না, ঢুকে পড়েছি আবহমান কোনো গাঁজার আড্ডায় 
                       ………..
                       এইসব অক্ষরের জন্য এবার শুধু বারুদবমি, শনির থানের সিঁদুর,
                       রাজকীয় ঘাম আর ভ্রূ-নিতম্বের গমপেষাই যন্ত্র –”

       এই কবিতার যে অন্তরীণ অনুসন্ধান, যে মনোবেদনার চরাচর, যে বুক মোচড়ানো কষ্ট, তার আবেদন ঘিরে রাখে তরুণ কবি সজল দাস-কেও। তাই শিরোনামহীন (কেবল সংখ্যা-চিহ্নিত) কিছু কবিতায় তিনি সেই মনপ্রবাহকেই ধরে রাখেন। লিখে রাখেন।

                       
                        লিখতে লিখতে মানুষ
                       একদিন শব্দের কাছে পৌঁছে যায়
                       ...
                       একদিন ঝড় আসে
                       ভাঙা শব্দের ভিতর ভাঙা একটি সাইকেল পড়ে থাকতে দেখা যায়

                       
                       একদিন লেখা ফিরে আসে নিজের রাস্তায়
                       অন্ধকারে মনে হয় ঢেউ

                       শুধু বালির দাগ
                       অযথাই লিখে রাখছে

       আমরা টের পাই, কেমন করে বালির আলপনা এঁকে ঝড়ের মধ্যে দিয়ে একদিন মানুষ পৌঁছে যায় শব্দের কাছে।  

       এমনি করে সজল দাস পুনর্জন্ম দেন কবি দেবাশিস্‌ তরফদারেরনভেম্বর ১৯৮২কবিতাকেও। শিরোনামহীন এই বিনির্মানেও সজল খুঁজতে থাকেন নিজেকে। ভেতর ঘরের থেকে তুলে আনতে চান অস্ত্বিত্বের ভাবনাকে। তাঁকে প্রশ্ন করেন। বিদ্ধ করেন।

                       “রক্তে ভেজা এসব আয়না
                       আর ক্ষয়িষ্ণু সব পাথর পাশাপাশি রেখে
                       একা থাকতে পারবে তো বালির শহরে!

       উত্তর হয়ত মেলে না। কিন্তু সজলের অনুভূতি প্রদেশ পাঠককে ঠিকই নিয়ে যায় সেই অমোঘ ও নিরাভরণ ভাবনার কাছে, যেখানে একজন সংবেদনশীল কবিই শেষমেশ লিখতে পারেন

                       “ছেলেমানুষ বলে ক্ষমা হয়েছিল ঘড়ি
                        ভাঙার পর সব ঘরই ঠিক
  
       সত্যিই তো। সমস্ত ভাঙচুরের পর পড়ে থাকা সেই আদিমতম শব্দ বা আখরের নির্ভারেই তো কোনো না কোনোভাবে যেতে চাই আমরাও।

       সজল সেই রাস্তা নির্মাণ করতে জানেন। তার মানচিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর এইসব বিনির্মাণে।


সজল দাস-এর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা

শুকিয়ে যাওয়া বিষয়ে ।। জয়দীপ মৈত্র

ছুঁচ দিয়েও ফুল তৈরি হয়
রুমাল এমন বাগান
সুতোর ভেতর দিয়ে
সে সব ফুলের কাছে
নিঃশব্দে ঠিক পৌঁছে যায় জল


আঘাত ও অপেক্ষা ।। অমিতাভ মৈত্র

দশ টনের একটা হাতি মৃত্যু থেকে ফিরে এসেছে আজ জলের ওপরে লাল রোদ
ঢিলে পাৎলুন আর ড্রেসিংগাউন পরা আগুন বহুদিন পর আবার
                                 হাসিমুখে নেভাতে বেরিয়েছে নিজেকে
কালো হাঁসের ভেতর দিয়ে যে সব বালিয়াড়ি একদিন প্রবাহিত হয়েছিল
আজ ঢেউ থামিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের কালো শরীরের ছায়ায়,
                            ওষুধ দিয়ে বিস্ময়হীন করা হচ্ছে
কেন যে আমি অপেক্ষা ও আঘাত করছি এমন দরজায়
                        যা এভাবে খোলে আর বন্ধ হয়ে যায় একা একা


বন্ধুবান্ধব ।। অমিতাভ প্রহরাজ

হাস্যাস্পদ একদিন মারা যাবে
জ্ঞাতব্য তথ্যের মতো সরু সরু কথাগুলি ভাবলেই
                        মনখারাপ করে আসে চতুর্দিকে
সকালে এসেছে, এসেই চতুর্দিকে বসে আছে আমার
জরায়ুজনিত কোন ট্রান্সফার নেই আমাদের
শুধু আমি প্রচন্ড যেন-আসে হয়ে বসে থাকি আর উনি আসেন
আমাদের মাঝখানে নাতিদীর্ঘ বিতাড়িত হয়েছে
ওষ্ঠরোগাক্রান্ত চোখ দুজনের
কথাবার্তার দিকে সুসময়দৃষ্টিতে দেখি ফ্যালফ্যাল করে
এ প্রিয় স্পষ্টগুলি যেন না কখনো ফুরোয়
আহা আহা আমি সুতীব্র যেন-থেকে-যায় করি এক পুরুষের


বিনির্মাণ করলেন কৌশিক চক্রবর্তী

চাঁদ বিষয়ক ।। কৌশিক চক্রবর্তী

জলের ডাকনাম থেকে
ব্যক্তিগত চাঁদ নেমে আসে
ট্রেকারের ছাদে তার ভ্রমণ পেটিকা
এই জল স্বপনেরা বানায় একা একাই
রাত তখন ঘুম থেকে উঠছে

সূত্র: শুকিয়ে যাওয়া বিষয়ে ।। জয়দীপ মৈত্র


আমি ও আচমকা ।। কৌশিক চক্রবর্তী

ঘুড়ি পালানো সুতোর হাল্‌কা
ভেজা দরজার পাশে
চলে যাওয়া আঁকে ...

বুকের ওপর রঙ ছড়িয়ে
একে একে কারা যেন নিজেদের গাইতে এসেছে

সাদা ম্যাপের ভেতর দিয়ে একদিন
সেই গান পেরোনোর পিকনিক হবে রাস্তায়

খুব সুরতিয়া ... তোর ঠোঁটে সেইদিন চুমু খাব
একবার হাট করে খুলে দিয়ে
তারপর হয়ত বা ভয় পেয়ে বন্ধও করে দেব
আচমকা

সূত্র: আঘাত ও অপেক্ষা ।। অমিতাভ মৈত্র


অচেনার এক দুই ।। কৌশিক চক্রবর্তী

একটা ভুল মাঝেমাঝে এসে
সোজা সিঁড়িতে বসে পড়ে
মুখভাঙা চাঁদের কথা ভাবলেই
ডানদিক থেকে মনকেমনের দাগ লাগে
স্নানে এসো,
ঝিলিমিলি রেখে যাও
আদরে

এই জামার কোনো ফুলতোলা নেই
কেবল তার না থাকার মতন
কেবল তার হ্যাঁ থাকার হয়ত

ভিজে বালিশের দিকে হাবা হয়ে
চেয়ে থাকি
সামান্য শব্দে আলো নেভা পর্যন্ত
অপেক্ষারা ডোরবেল নাড়ে

সারারাত  রাতসারা হলে আমি চাই
আর কেন যে,
পাওয়ার আলো চিনতে পারি না ...

সূত্র: বন্ধুবান্ধব ।। অমিতাভ প্রহরাজ


বিনির্মাণ প্রসঙ্গে
সজল দাস

আমি ও আচমকা 
                   “কেন যে আমি অপেক্ষা ও আঘাত করছি এমন দরজায়
                                          যা এভাবে খোলে আর বন্ধ হয়ে যায় একা একা

       একদিন পড়তে পড়তে থমকে দাঁড়িয়েছিলাম এইখানে। নিজের সমস্ত বোধ ও বুদ্ধি নিয়ে এইখানে এসে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। এমন এক কথা যা চলে গিয়েও অন্ধকারে কোথাও ধাক্কা খেয়ে আবার ফিরে আসে। ভেতরে দুলতে থাকে। দুলতেই থাকে। আর সেই লেখার একপ্রকার মুক্তি আমি পেলাম। হাওয়ার প্রতিশব্দ লিখতে গিয়ে আমরা যেমন হাওয়াই লিখি, কৌশিকবাবুও তাই করলেন। শুধু হাওয়া কোন দিক থেকে বইছে তার ইঙ্গিতটুকু সঙ্গে রাখলেন। তাতে করে ঐযে ফিরে ফিরে আসা তার কিছু প্রতি-ফিরে আসে তৈরি হল। কিছু শব্দ যোগ হল। মানবীয় কিছু দৃশ্য অনুভূতি যোগ হল; বা তার ইশারা দেওয়া রইল। এও একপ্রকার ক্যাওস, কুহেলি রচনা। খুব সুরতিয়া’ – এটুকু পড়ে আমার ভিতরে একটা মিষ্টি গন্ধ টের পাই আমি, শব্দময় গন্ধ। মনে হয় কোনো ময়রা গান গাইতে গাইতে মিষ্টি তৈরি করছে। কিংবা বৃষ্টির পর মাটিও একধরণের গন্ধ। কিন্তু এখানে পাঠক থামতে পারেন না। সেই স্পেসই নেই। তিনটে ডট দিয়ে উনি এখানে পাঠককে পরের পাঁচটি শব্দে নিয়ে চলে যান। এবং তোর ঠোঁটে সেইদিন চুমু খাবপড়ার পরই পাঠক একটি দিক দেখতে পান। একটি পরিচিত গন্তব্য কল্পনা করে নেন। অথচ খুব সুরতিয়ার গন্ধ তখনও তাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। খুব সুরতিয়াথেকে তিনটে ডট দিয়ে তোর ঠোঁটে সেইদিন চুমু খাবএই স্পেসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে মুন্সিয়ানা।

       এবার এই যে দিক পাঠক দেখতে পেল; এই যে গন্তব্য আমি মনে মনে স্থির করে নিতে চলেছি, তাকে কবি ভাঙলেন। এবং ভাঙলেন অমিতাভদার লেখাটির অনুরূপ একটি লাইন দিয়েই – ‘একবার হাট করে খুলে দিয়ে/ তারপর হয়ত বা ভয় পেয়ে বন্ধও করে দেব আচমকাপ্রথম লাইনটা পড়ে পাঠক কিন্তু তার আগের অবস্থান থেকে সরছেন না। মনে মনে বরং সেই দিকেই আরও খানিক এগিয়ে যাচ্ছেন। তারপর হয়ত বা ভয় পেয়ে বন্ধও করে দেব আচমকাএইখানে এসে পাঠকের মুক্তি হয়। সমস্ত অঙ্ক তার সমাধান থেকে বহুদূরের কোনো রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে যায়। একটা ওজনহীনতা অনুভব হয় আমার। একটা শূন্য। হালকা ও নিরাকার। ধাক্কা খেয়ে নিজেকে দেখতে আসার মতো। নির্দেশ থেকে অনির্দেশের দিকে ভেসে যাওয়ার মতো। অবাক হলাম যখন বুঝলাম ঠিক এরকমই এক অনুভূতি হয়েছিল অমিতাভদার লেখাটা পড়েতাহলে ঐযে দিক, ঐযে গন্তব্য কৌশিকবাবু আমাদের দেখালেন!
আসলে বিরাট খোলা মাঠের মধ্যে
         অন্ধকারে
                   অন্ধ কোনো মানুষের
যেমন কোনো দিক হয় না, গন্তব্য হয় না। এ এক ভ্রম। এ শুধু জলে অনন্ত পা-খেলার মতো। অফুরন্ত শূন্যে অনিঃশেষ আওয়াজের বারবার চলে গিয়েও ফিরে ফিরে আসার মতো নিঃসহায়।

       আসলে আঘাত ও অপেক্ষালেখাটা আমার কাছে এই শেষ দুই লাইনের উপর দাঁড়িয়ে। অদ্ভুত হলেও সত্যি যে লেখাটা এখানে এসে শেষ হয় না। এখানে এসে লেখাটা অনন্তের সঙ্গে মিশে যায়। এই লাইন দুটো না থাকলেও কবিতাটা অন্য একটি কবিতাই হত; অমিতাভ মৈত্রসুলভ এবং অবশ্যই উচ্চমানের। শুধু এই দুই লাইনের জন্যই লেখাটা এই সবকিছুকে অতিক্রম করে গেল। এখন আমি আর কাউকে বলতে পারব না লেখাটা ভালো না খারাপ। শুধু বলতে পারি এই লেখাটার কাছ থেকে আমি আর ফিরতে পারব না কখনও। পুরীতে বেড়াতে গিয়ে এক বেঁটে ও কুশ্রী মানুষ সমুদ্রসৈকতের একদিক থেকে অন্যদিকে কিছু সময় পরপর মাছ ধরার জালে অসংখ্য শঙ্খ নিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। অদ্ভুত ফাঁকা তার দৃষ্টি। আশ্চর্য উপেক্ষা তার পা-টেনে-টেনে হাঁটার মধ্যে। জালে জড়ানো শঙ্খগুলো যেন তার দূরাগত কোনো অপেক্ষার প্রতীক। আমি এসব কিছু দেখছিলাম না। শুধু দেখছিলাম তার বারবার এগিয়ে এসে আমাকে অতিক্রম করে যাওয়াটুকু। আমাকে অতিক্রম করে শূন্যে এবং শূন্য থেকে ফিরে আরও কোনো শূন্যের দিকে চলে যাওয়াটুকু।

                                   “বুকের ওপর রঙ ছড়িয়ে
                                   একে একে কারা যেন নিজেদের গাইতে এসেছে

                                                                 আমি কি নিজেকে দেখতে পেলাম?

       শীতকালে আমাদের পাড়ায় খুব ভোরে কে যেন গান করতে করতে চলে যেত। সে কি আমার কেউ হয়! দুঃখ পেয়েছে বলে যে মেঘে বৃষ্টি হয়েছিল, তাতে ভেজার আগেই কেন যে আমি নৌকো বানিয়েছিলাম। স্যার বকবে জেনেও কেন যে বিশ্রী আর উল্টোপাল্টা সব রঙ দিয়েছিলাম খাতায় আঁকা ছবিতে। আর তারপর, আমাকে ভীষণ অবাক করে, বেগুনী রঙের মুখের পাশেই, আঁকার স্যার সুন্দর করে ভেরী গুডলিখে দিয়েছিলেন! আসলে সবাই যে, বুকের ওপর রঙ ছড়িয়ে নিজেকে গাইতে এসেছি, এটুকুই বুঝতে পারি এখন।
অচেনার এক দুই
একটা ভুল মাঝেমাঝে এসে
সোজা সিঁড়িতে বসে পড়ে

       বনে হারিয়ে গেলে মানুষ প্রথমে একটি রাস্তা খোঁজে। তারপর নিজের ভুল। আদতে ভুলই সেই পথ যা তাকে এতদূর নিয়ে এলো। আর কৌশিকবাবু সেই ভুলকেই সিঁড়িতে নিয়ে এসে বসালেন। এবং জল একটি আহ্বান। তাই স্নানে এসোজলের রাস্তায় যে আসে, তাকে কি ভাসানো যায় বলো? কাঠও ডোবে না, তাই নৌকা ফুটো হয়ে যায়। গাছের ভিতর এত বাতাস কে রেখেছিল কে জানে!

                                       ‘ভিজে বালিশের দিকে হাবা হয়ে
                                       চেয়ে থাকি

       বালিশ ভিজলে মনে হয়, তুলো একটি গাছ, দুঃখেরা বাসা বেঁধে থাকে। কিংবা দুঃখের গাছে তুলোই একটি ফল; বীজ ছড়াতে গিয়ে বাতাস তাদের ফাটিয়ে দিয়েছে। ভুল রাস্তায় এসে, কবি, হঠাৎ তাদের দেখতে পেলেন।

হাস্যাস্পদ একদিন মারা যাবে

       মজা হল, লেখার শুরুতেই যে প্রশ্নের সম্মুখীন হন পাঠক, তার কোনো উন্মোচন নেই লেখাটিতে। মনে হয় এ-এক কথোপকথন, নিজের সঙ্গেই। আর প্রতিটা লাইন একেকটা বিস্ময়সূচক চিহ্ন। উনি লিখলেন শুধু আমি প্রচন্ড যেন-আসে হয়ে বসে থাকি’; লিখলেন আমাদের মাঝখানে নাতিদীর্ঘ বিতাড়িত হয়েছে’! আসলে এর-থেকে স্পষ্টভাবে এই কথাগুলো বোধহয় বলাই যেত না। অথচ এই প্রথম এমন উচ্চারণ। এত সপাট যেন প্রতিটা প্রয়োগই নতুন মনে হয়। ওষ্ঠরোগাক্রান্ত চোখএর কথা আমি কীভাবে ভাবতে পারি? এই অতিপরিচিত অতিব্যবহৃত হালকা শব্দগুলিকে পাশাপাশি বসিয়ে কবি তাদের সম্পূর্ণ নতুন পরিচয় দিলেন। এখন এগুলি বিস্ফোরকের কাজ করছে। যেন হাজারো ছবি কক্ষচ্যুত হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে মাথার ভিতর।

এখন, লেখা দুটি যে
একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেঁটে যাচ্ছে
এটা পাঠক দেখতে পান।
এবং তাদের দূরত্বও।
বহুদূরের দুটি মানুষ একে অপরের দিকে যেভাবে তাকায়
গাছ গাছালির ফাঁক দিয়ে
আলো যেভাবে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে।
হাওয়ায় তার দেয়ালা রচিত হয়।
অন্ধকারে বসে থাকা মানুষ যেমন।
একই সাথে বিচ্ছিন্ন ও সংলগ্ন।
লেখাদুটিকে সেভাবেই দেখতে থাকি আমি।

       বন্ধুবান্ধব লেখাটিতে কবি যেখানে কারোর থেকে যাবার কথাই বারবার বলছেন, তার অস্তিত্বের প্রকাশকেই ফুটিয়ে তুলতে চাইছেন তার ফিরে আসার মধ্যে দিয়ে। অন্যদিকে, ‘অচেনার এক দুই’-এ কারোর না-থাকার অনুভূতিই ফিরে ফিরে আসে। কিংবা থাকা-না-থাকার এক অপরূপ ধন্দ তৈরী হয়ে থাকে চারপাশে।  


       আশ্চর্য লাগে, বারবার পড়েও বন্ধুবান্ধবলেখাটির মুগ্ধতা ফুরোয় না। আমি এখনও ভাবতে পারি না হাস্যাস্পদ একদিন মারা যাবেদিয়ে কোনো লেখা শুরু হয়েছিল। কারোর কখনও মারা যাবার কথা দিয়ে যে লেখার শুরু, সেখানে আসলে তার থেকে যাওয়ার কথাই লেখা হল শেষ পর্যন্ত!

চাঁদ বিষয়ক 
       আমাদের পেয়ারা গাছটি বন্যার পর মারা গিয়েছিল। জলের কাছে হেরে গিয়ে আমাদের পেয়ারা গাছ কোনো এক রাত্রে নিজের সমস্ত পাতা উড়িয়ে দিয়েছিল আকাশে। সকালে চুপচাপ আমরা এসে দাঁড়িয়েছিলাম অসংখ্য ভেজা পাতার ভিতর। আর বুঝে নিয়েছিলাম পাতা ভিজে গেলে তাতে আর লেখা যায় না। সেদিন থেকে আমি শুধু জলের বিপরীতে হেঁটে গেছি। আমি শুধু লেখার খাতা বাঁচিয়ে রেখেছি বৃষ্টি থেকে, ঢেউ থেকে, কান্না থেকে।

                                          ‘ছুঁচ দিয়েও ফুল তৈরি হয়
                                          ‘রুমাল এমন বাগান

       ছুঁচ দিয়েও ফুল তৈরি হয়... ফুল... ফুল... ফুল তৈরি হয়... রুমাল... রুমাল... রুমাল... এমন বাগান... এমন... এমন... বাগান... আমার ভিতর শব্দগুলো এভাবে বাজতে থাকে। আর কোনো এক রাতের আকাশে টুকরো করে উড়িয়ে দেয় আমাকে। গুহার ভিতরে ঝরনার প্রপাত যেরকম। মন্দ্র। যেন আমি বাইরে রয়েছি। ভেতরে কী আছে আমি জানি। তবু ঢোকার সাহস নেই। কী মৃদু উচ্চারণ! কখনও কেউ আস্তে কথা বললে চুপ করে থাকতে হয়। আর কথা চলে না।

       খন্ড করলেও যেমন হীরের ঔজ্বল্যে পৌঁছনো যায় না। যেন রহস্যময়তাই একে দুর্মূল্য করেছে। কোনো কোনো ঋণ শোধ করা যায় না। আবার বললেই তা ফুরিয়ে যায়। অবশেষে, এই দু-লাইনের কোনো ব্যাখ্যা আমার হল না। আমার বোধের বাতাসে তাকে তুলোর মতো উড়তে দিলাম শুধু।

জলের ডাকনাম থেকে

       জলের স্বপ্নে চাঁদ আসলে একটি নৌকা। ভেসে গেলে তাকেই আবার ফিরিয়ে আনে রাত। গুছিয়ে বলা কোনো কথার মতো, নিজেরই চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তখন। গুনগুন করে নিজেকে শান্ত করে যে গান, জলের ফেনিলাবর্তে তাকেই ঘুরে মরতে দেখি।

       স্বপনে বানানো জল মেঘের দিক থেকে এলো। এবার তাকে কোথায় বসাবো! উঠোনে গামলা পেতে দিলাম। একধরণের ফল হয় জলে দিলে খুলে যায়। পট করে শব্দ করে। মানুষও তাই। ঘুমের মধ্যে বোধের আকাশ খুলে যায়। আকাশের ভিতর, বৃষ্টির দরজা খুলে, ভ্রমণে-হারানো-মানুষ অস্পষ্ট ছাতার মতো একা একা বাড়ি ফিরে আসে 

       মাঝে মাঝে মনে হয় রুমালই শ্রেষ্ঠ বিকল্প। মাটির মতো সর্বংসহা। মানুষের দুঃখকষ্ট নিয়ে গোপনে নরম হয় কেউ। মানুষের কান্না নিয়ে কারা সব ঘুরতে চলে যায়। ভাঙা আর আবছা সব কাচের ভিতর দেখা হয়ে তাদের। ঝাপসা বলে চিনতে পারে না। আগুনের সামনে নিজেকে অসহায় লাগে তখন। আলতো ফুলের সামনে নিজেকে অচেনা লাগে। মনে হয় ছুঁচ এমন দর্জি বাগানও সেলাই হয়ে যায়। আর মালির মনের কথা শুশ্রূষায় হালকা হয়ে পৌঁছে যায় মাটির কাছাকাছি।






আপনার মূল্যবান মতামত: