নির্বাচিত দুই কবি, একটি জুটি। বেছে নিলেন প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা। বদলে দেওয়া হল বাক্স।
একে অন্যের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণ করলেন। আবার বাক্সবদল।
নিজের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণের আলোচনা করলেন কবি-জোড়।
রাদ আহমদ-এর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা
সঙ্গতি ।। শহীদ কাদরী
(অমিয় চক্রবর্তী, শ্রদ্ধাষ্পদেষু)
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
একাকী পথিক ফিরে যাবে তার ঘরে
শূন্য হাঁড়ির গহ্বরে অবিরত
শাদা ভাত ঠিক উঠবেই ফুটে তারাপুঞ্জের মতো,
পুরোনো গানের বিস্মৃত-কথা ফিরবে তোমার স্বরে
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
ব্যারাকে-ব্যারাকে থামবে কুচকাওয়াজ
ক্ষুধার্ত বাঘ পেয়ে যাবে নীলগাই,
গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলি গানের- তোমরা দু'জন একঘরে পাবে ঠাঁই
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
হৃদয়পুর ।। শক্তি চট্টোপাধ্যায়
তখনো ছিলো অন্ধকার তখনো ছিলো বেলা
হৃদয়পুরে জটিলতার চলিতেছিলো খেলা
ডুবিয়াছিলো নদীর ধার আকাশে অধোলীন
সুষমাময়ী চন্দ্রমার নয়ান ক্ষমাহীন
কী কাজ তারে করিয়া পার যাহার ভ্রুকুটিতে
সতর্কিত বন্ধদ্বার প্রহরা চারিভিতে
কী কাজ তারে ডাকিয়া আর এখনো, এই বেলা
হৃদয়পুরে জটিলতার ফুরালে ছেলেখেলা?
ইকারুসের আকাশ ।। শামসুর রাহমান
গোড়াতেই নিষেধের তর্জনী উদ্যত ছিলো, ছিলো
সুপ্রাচীন শকুনের কর্কশ আওয়াজে
নিশ্চিত মুদ্রিত
আমার নিজস্ব পরিণাম। যেন ধু ধু মরুভূমি
কিংবা কোনো পানা পুকুরে কি জন্মান্ধ ডোবায়
অস্তিত্ব বিলীন হবে কিংবা হবো সেই জলমগ্ন ভুল প্রত্ন
পরিশ্রমী, ধৈর্যশীল, উদ্যমপ্রবণ ধীবরের জাল যাকে
ব্যাকুল আনবে টেনে নৌকোর গলুইয়ে-
এইমতো ভয়ংকর সংকেত চকিতে
উঠেছিলো কেঁপে রুদ্ধ গোলকধাঁধায়।
আমিতো বারণ মেনে বিশ্রুত স্থপতি
ধীমান পিতার
পারতাম জলপাই আর বৃষমাংস খেয়ে,
পান করে চামড়ার থলে থেকে উজ্জ্বল মদিরা
এবং নিভৃত কুঞ্জে তরুণীকে আলিঙ্গনে মোহাবিষ্ট করে
ধারালো ক্ষুরের স্পর্শসুখ নিয়ে প্রত্যহ সকালে
সাধারণ মানুষের মতো গোচারণ, শষ্যক্ষেত আর
সন্তান লালন করে কাটাতে সময়।
পারতাম সুহৃদের সঙ্গে প্রীতি বিনিময়ে
খুশি হতে, তৃপ্তি পেতে পাতার মর্মরে,
বনদোয়েলের গানে, তামাটে দুপুরে
পদরেখা লাঞ্ছিত জঙ্গলে
নিজেকে নিযুক্ত করে মধু আহরণে।
কী-যে হলো, অকস্মাৎ পেরিয়ে গোলকধাঁধা পিতৃদত্ত ডানা
ভর করে কিছুক্ষণ ওড়ার পরেই
রৌদ্রের সোনালি মদ আমার শিরার
ধরালো স্পর্ধার নেশা। শৈশবে কৈশোরে কতদিন
দেখেছি পাখির ওড়া উদার আকাশে। ঈগলের
দুর্নিবার ঊর্ধ্বচারী ডানার চাঞ্চল্যে ছিলো সায়
সর্বদা আমার, তাই কামোদ্দীপ্তা যুবতীর মতো
প্রবল অপ্রতিরোধ্য আমার উচ্চাভিলাষ আমাকে অনেক
উঁচুতে মেঘের স্তরে স্তরে
রৌদ্রের সমুদ্রে নিয়ে গেলো। দ্বিধাহীন আমি উড়ে
গেলাম সূর্যের ঠোঁটে কোনো রক্ষাকবচবিহীন
প্রার্থনার মতো।
কখনো মৃত্যুর আগে মানুষ জানে না
নিজের সঠিক পরিণতি। পালকের ভাঁজে
সর্বনাশ নিতেছে নিশ্বাস
জেনেও নিয়েছি বেছে অসম্ভব উত্তপ্ত বলয়
পাখা মেলবার, যদি আমি এড়িয়ে ঝুঁকির আঁচ
নিরাপদ নিচে উড়ে উড়ে গন্তব্যে যেতাম পৌঁছে
তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ?
তবে কি পেতাম এই অমরত্বময় শিহরণ?
তবে কি আমার নাম স্মৃতির মতন
কখনো উঠতো বেজে রৌদ্রময় পথে জ্যোৎস্নালোকে
চারণের নৈসর্গিক, স্বপ্নজীবী সান্দ্র উচ্চারণে?
সমগ্র জাতির কোন কাজে লাগবে না
এই বলিদান, শুধু অভীপ্সার ক্ষণিকের গান
গেলাম নিভৃতে রেখে ঝাঁ-ঝাঁ শূন্যতায়।
অর্জন করেছি আমি অকাল লুপ্তির বিনিময়ে
সবার কীর্তনযোগ্য গাথা,
যেহেতু স্বেচ্ছায়
করেছি অমোঘ নির্বাচন
ব্যাপ্ত, জ্বলজ্বলে, ক্ষমাহীন রুদ্র নিজস্ব আকাশ।
বিনির্মাণ করলেন সব্যসাচী হাজরা
পৃথিবীর এককোণে ।। সব্যসাচী হাজরা
ইদানীংকালের আলো নিতান্ত ইদানীং আমাদের শান্তিদা। তার ফোলানো ফাঁপানো ভোর, ওহো তার বিস্তারিত পাখি। তার এযাবৎ ভোর, জগতের মাছ, শান্তিদা’র ভাষা মিলে যায়। মাছ মিলে যায়, ডুবতে ডুবতে ভোরের কাছে আসে।
শান্তিদা’র ভোর শিকার মেলায়
যুদ্ধ মেলায়
গানে হাওয়া দ্যায় গুনগুন ক’রে
এই তার বিশ্বলোক
এই তার ৪.৮
এই তার % প্রেম
হোঁচট খেলো শান্তিদা
‘অ’ লিখলো পৃথিবীর এককোণে ব’সে
অন্য কোণে নিজের নাম
ঘুড়ি উড়লো না…
আমরা শুধু
দুটো কোণ জুড়তে গিয়ে
হাত কাটলাম পৃথিবীর মাঝে
সূত্র: সঙ্গতি ।। শহীদ কাদরী
কলিংমন ।। সব্যসাচী হাজরা
মানুষের কলিংমন মানুষের
আসবে ব’লে ক্ষমা করছি আলো
সে এলো খুলতে বলতে দরজায়
ছেলেখেলার পর
যখন দ্বিতীয়বার বেলা ক’রে এলো...
সূত্র: হৃদয়পুর ।। শক্তি চট্টোপাধ্যায়
গোলক মোচন ।। সব্যসাচী হাজরা
কৃষ্ণলোক থেকে বেরিয়ে আসছে সুতো
তার টান ধ’রে ছুটে আসছে একাকার ইন্ধন
ভাসিয়ে দাও মহারূপের দুই জমি , সেই মজমজার হাট, তার বিচিত্র ষাঁড়
সচিত্র মানুষের লিঙ্গ এটা নয়
দেখেছি আলোর খোসা ছাড়ানো ছড়ানো আলোর কাছে
গলনাঙ্ক শিখে কৃষ্ণলোকে ডুবে গ্যালো মুখ
আমি আলোময় আর চারিদিকে
খালি-গলার হাহাকার
সুতো ধ’রে নেমে যাচ্ছে আলো
আমরা বিশ্বলোকে খুঁজে পাই মোমের কাজ মোমের কারিগর
লিলিদি’র আজ গোলক মোচন
তাই অর্ধষাঁড়ে ফুটে উঠলো কালো ইতিহাস
সেই গলা সেই হাহাকার
সেই ডানা তাই এমন আলোয় আঁকো
যা যুদ্ধে পরার
যা সূর্য ডোবার...
সূত্র: ইকারুসের আকাশ ।। শামসুর রাহমান
বিনির্মিত কবিতার উপর আলোচনা
রাদ আহমদ
পৃথিবীর এককোণে
"সঙ্গতি" প্রথমে লিখলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী-
"মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোড়ো বাড়িটার
ঐ ভাঙ্গা দরজাটা।
মেলাবেন ।"
"সঙ্গতি" প্রথমে লিখলেন কবি অমিয় চক্রবর্তী-
"মেলাবেন তিনি ঝোড়ো হাওয়া আর
পোড়ো বাড়িটার
ঐ ভাঙ্গা দরজাটা।
মেলাবেন ।"
উনি
কি আশাবাদী ? নাকি ইচ্ছে করেই অনেকটা
বিদ্রূপের মতো বলা, এত অমিল - একদিন মিলে যাবে। মিলে কি
যাবে আদৌ? যে-কোনোটাই হতে পারে। এছাড়াও কবি ব্যবহার করলেন নাগরিক নানা দৃশ্য। উনার
কবিতার কথক-টি যেন পুরো মানবজাতির পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন।
এখানে ব্যক্তিগত কবির উপস্থিতি খুব সামান্য ভাবে আসলেও ('সমাজধর্মে আছি বর্মেতে আঁটা') - শেষ পর্যন্ত এটা যেন পুরো মানব
সভ্যতার পক্ষ নিয়ে নৈর্ব্যক্তিক এক জনার 'সত্যবচন' প্রকাশ করা। এখানকার ‘আমি’ অনেক বিস্তৃত। একক ‘আমি ‘ নয়।
তাঁকে
নিবেদন করেই শহীদ কাদরী একই নামে লিখলেন আরেকটি কবিতা - সঙ্গতি - যেখানে বললেন, মিলে তো যাবেই। সুন্দর
ভাবেই মিলে যাবে সব, কিন্তু এই মিলবার পরেও কাঙ্ক্ষিত "শান্তি" কি মানুষ পাবে? উনি প্রেমের প্রসঙ্গ নিয়ে এসে
চমৎকার কিছু ইতিবাচক চিত্র দেখালেন-
"গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলী গানের- তোমরা দু'জন এক ঘরে পাবে ঠাঁই"
কিন্তু ভিতরে ভিতরে বয়ে যাচ্ছে অতৃপ্তির যন্ত্রণা।
"কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না..."
"গ্রামান্তরের বাতাস আনবে স্বাদু আওয়াজ
মেয়েলী গানের- তোমরা দু'জন এক ঘরে পাবে ঠাঁই"
কিন্তু ভিতরে ভিতরে বয়ে যাচ্ছে অতৃপ্তির যন্ত্রণা।
"কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না..."
প্রেমের
মত একটা শাশ্বত/সার্বজনীন বিষয়কে অবলম্বন করে উনি অগ্রসর হলেন।
একটু
লক্ষ্য করলে আমরা দেখি, উনি কিন্তু অমিয় চক্রবর্তীর চাইতে তুলনামূলক ভাবে কিছুটা ব্যক্তিগত
পরিসরে চলে আসলেন। এই কবিতাতে তিনটা নির্দিষ্ট চরিত্র দেখা যাচ্ছে - কবি নিজে, একজন প্রেমিক আর একজন
প্রেমিকা। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে কবিতাটা কবির ব্যক্তিগত ক্ষোভ। প্রেমিকা
চরিত্রটির সাথে হয়তবা কবি-কথকের পূর্বের কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে। শেষ পর্যন্ত সে
বিষয়ে কোনো ইঙ্গিত দেয়া হয়নি যদিও। কিন্তু তারপরেও-শেষ
পর্যন্ত যেন তা মানুষেরই একটা "চিরন্তন" সত্যকে প্রকাশ করার প্রক্রিয়া। জীবনে অনেক কিছুই মিলে যাবে, কিন্তু মানুষ তারপরেও
শান্তি বলতে কিছু পাবে বলে মনে হয় না। - এত স্পষ্ট ভাবে যদিও
কথাটা কাদরী বলেন নি -কবিতাতে তা বলা
সম্ভব-ও না। তবে উনি ফুটিয়ে তুলেছেন, আর আবেগ দিয়ে আমরা, পাঠক পাঠিকারা তা হয়ত অনুধাবন করে
নিচ্ছি। অর্থাৎ কাদরী এখানে পূর্বসূরি অমিয় চক্রবর্তী থেকে কিছুটা ব্যক্তিগত হয়ে
উঠলেন, তবে, শেষ পর্যন্ত উনার কথাটাও যেন চিরন্তন মানবজাতিকে উদ্দীষ্ট করে বলা কিংবা
মানবজাতির জন্য প্রযোজ্য।
'সঙ্গতি' কবিতার সূত্র ধরে কবি
সব্যসাচী হাজরা যখন "পৃথিবীর
এককোণে" লিখলেন, উনি সরাসরি একজন
নির্দিষ্ট জলজ্যান্ত মানুষকে নিয়ে আসলেন, যাঁর নাম "শান্তি" কিংবা "আমাদের
শান্তিদা" । এই শান্তিদা একজন নির্দিষ্ট
মানুষ। যিনি কবি-কথকের পরিচিত। যাঁর একটা 'ফোলানো ফাঁপানো ভোর' আছে। সেই ভোরে অনেক কিছু মিলেও যায়। প্রাপ্তি, আবার প্রাপ্তিকে একটু
ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিলিয়ে নেওয়া - এই নিয়ে ভালোই কাটছিল
তাঁর সময়। অর্থাৎ শান্তি দা শেষ পর্যন্ত একজন নির্দিষ্ট মানুষ, আবার কবি-কথক-ও এখানে একজন ব্যক্তি-মানুষ, যিনি শান্তি দা কে চিনেন। এখানে কিন্তু নৈর্ব্যক্তিকতা বজায় রাখা হলো
না ইচ্ছে করেই।
একদিন
শান্তিদা-র হিসাব-নিকাশ অন্যরকম হয়ে যায়। একটা কাব্যিক দৃশ্য
আমরা দেখতে পাই-
"...'অ' লিখলো পৃথিবীর এক কোণে ব'সে
অন্য কোণে নিজের নাম..."
"...'অ' লিখলো পৃথিবীর এক কোণে ব'সে
অন্য কোণে নিজের নাম..."
পুরোনো
বিষয়টা ফিরে আসছে – সঙ্গতি, কিংবা অসঙ্গতি-
এই না মেলাতে পারার ঘটনাটা খুব সুন্দর জ্বলজ্বলে ভাবে ফুটে উঠছে কবিতায়। এমনকি, কিছুটা যেন এভাবেও বলা যায়, মেলানো যাচ্ছে না দেখে শান্তিদা আর কথক(কবি কিংবা পাঠক) - দুজনেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ছেন। এই বিহ্বলতার স্বাদ পুরো মাত্রায় সঞ্চারিত হচ্ছে পাঠক পাঠিকার মনে।
"দুটো কোণ
জুড়তে গিয়ে/ হাত কাটলাম ..."
এই না মেলাতে পারার ঘটনাটা খুব সুন্দর জ্বলজ্বলে ভাবে ফুটে উঠছে কবিতায়। এমনকি, কিছুটা যেন এভাবেও বলা যায়, মেলানো যাচ্ছে না দেখে শান্তিদা আর কথক(কবি কিংবা পাঠক) - দুজনেই হতবিহ্বল হয়ে পড়ছেন। এই বিহ্বলতার স্বাদ পুরো মাত্রায় সঞ্চারিত হচ্ছে পাঠক পাঠিকার মনে।
['অ' এর সাথে 'শান্তি' মিললে কী হয় - সে প্রসঙ্গে আর গেলাম না। এটা
কবিতাকে নিয়ে গেছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক মেজাজে আর স্বতন্ত্র বক্তব্যে। খুব চমৎকার।
আমরা বরং পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি]
যেটা
বলতে চাইছি - এই সঙ্গতি/অসঙ্গতির বিষয়টা
বোঝাতে গিয়ে কবি নিয়ে আসলেন একজন জলজ্যান্ত ব্যক্তি মানুষকে। শান্তিদা একজন
সাবজেক্ট। এখানে আবছায়ার আড়ালে কবি নিজেকে বা শান্তি দা কে আড়াল করেননি। শান্তি দা-র কাছ থেকে যে ঘটনাটা আমরা পেলাম - সেটা সমস্ত মানবজাতির জন্য
প্রয়োজনীয় - এই কথাটারও কোনোরকমের
ইঙ্গিত দেওয়া হয়নি। "চিরন্তনতা"-র দিকে যাওয়া হয়নি। ঘটনা যেমন আছে তেমনই বা as is. কবি কোনো মহাসত্য হিসাবে একে
উপস্থাপন-ও করছেন না - বা মহাসত্য হিসাবে এটাকে
প্রতিষ্ঠিত করার জন্য কোনোরকমের সামান্যতম ইঙ্গিত-ও দিচ্ছেন না। আমরা বড়জোর শান্তি দা'র প্রতি কবি-কথকের পেলব ভালোবাসা টা নিজের ভিতরে টের
পাচ্ছি, না মিলাতে পেরে নিজেরাও কিছুটা
হতবিহবল হয়ে পড়ছি। এই হতবিহবল বোধ টা এ কবিতার অন্যতম প্রধান সুর।
ঠিক
এখানেই আমার মনে হয় কবিতাটার সবচেয়ে সুন্দর বিনির্মাণ হয়েছে। বিষয় একই, সঙ্গতি-অসঙ্গতির
দ্বন্দ্ব। কিন্তু পরিবেশ, উপাদান, চিত্রনাট্য, লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য কত না
ভিন্ন !
কবিতা
সময়ের সাথে সাথে ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। গদ্যের দিকে টার্ন নিতে চাইছে - এটা কেউ কেউ বলে থাকেন। এ কবিতাটা
সেই তত্ত্বের যেন একটা ভালো উদাহরণ। যদিও এখানে ব্যক্তি-কবি, কথক কিংবা আমরা পাঠক পাঠিকারা যেন 'অবজারভার' মাত্র। শান্তিদা-র কাছ থেকে একটা দূরত্ব আমাদের থেকেই যায় - যতই ভালোবাসা অনুভব করি না কেন। - এই দূরত্ব কিংবা ঋষি-সুলভ নির্লিপ্ততা
এ কবিতার আরেকটা অঙ্গ।
কলিংমন
কবিতার
ইন্টারপ্রিটেশন তো আসলে একেক জন একেক ভাবে করবেন। আবার এটাও ঠিক যে - একটা কবিতার নানারকমের
ইটারপ্রিটেশনের মধ্যে সবগুলাই ঠিক। সত্যগুলাই যেন প্যারালেল-এ অবস্থান করে।
কবি নিজেও কখনো – এক ইন্টারপ্রিটেশন বাদ
দিয়ে – অন্যটা বেছে নেন না। ‘কলিংমন’ এর আলোচনায় তাই আমি আমার
নিজের ইন্টারপ্রিটেশন ধরেই এগিয়ে যাব ...
'কলিংমন' কবিতার চাবি-শব্দ-গুচ্ছ, অর্থাৎ যার মাধ্যমে কিনা
দরজা খুলে এই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করা যাবে, সেই চাবি-শব্দ-গুচ্ছ, আমার মতে, এই অংশটা-
"ক্ষমা করছি আলো"
অদ্ভুত
বিপরীতধর্মী একটা কথা। আলো তো আমরা পজিটিভ বলে জানি। আনন্দ, আশা, স্পষ্টতা ইত্যাদি যা কিছু
শুভ কিংবা মঙ্গলকর। কিন্তু এই আলো কে 'ক্ষমা' করতে হবে কেন?
একটাই
সম্ভাব্য ক্ষেত্র হতে পারে, যখন কবিতার কথক-ব্যক্তি আলোর
স্পষ্টতার চেয়ে অস্পষ্টতাকে বেশি ভালোবেসে ফেলবেন।
কবিতাটা
খুব সুচারুভাবে একটা সেটিং কিংবা মঞ্চ তৈরি করে দিয়েছে। 'কলিংমন', মনে পড়াচ্ছে, 'কলিং বেল'। অর্থাৎ কবি বা কথক একটা ঘরের
মধ্যে আছেন। সম্ভবত একটা কলিং বেল বা কলিংমনের জন্য অপেক্ষা করছেন। উনি স্পষ্টতাকে
নয়, অস্পষ্টতাকেই বেশি ভালোবাসছেন।
কিন্তু, আবার সাথে সাথে এই পর্যায়
এসে এটাও বুঝতে হবে, স্পষ্ট/অস্পষ্টের বিচার মানুষ যতক্ষণে করে ফেলে - ততক্ষণে সে কিন্তু স্পষ্টতার
স্বাদটাও পেয়ে গেছে। নইলে এই স্পষ্ট-অস্পষ্ট বিচার করা সম্ভব নয়।
অর্থাৎ, কলিংমনের মাধ্যমে যাঁর
আগমন হবে - তিনি কবির কাছে একাধারে
স্পষ্ট এবং অস্পষ্ট । কবি স্পষ্টতাকে চাইছেন (নাহলে অপেক্ষা
করবেন কেন?), কিন্তু আবার যেন তাকে ঠিক মেনেও
নিতে পারছেন না। স্পষ্টতাকে 'ক্ষমা' করতে হচ্ছে।
এর
পর পরই দেখা যাচ্ছে, কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির আগমন খুব সাদামাটা। কিছুটা ক্লান্তিকর যেন-
এবং সে দ্বিতীয়বার এলো, কিন্তু "বেলা করে" এলো। আরও আগে আসলে হয়ত তীব্রভাবে অনুভব করা যেত (?) ।
"সে এলো খুলতে বলতে দরজায়...",
এবং সে দ্বিতীয়বার এলো, কিন্তু "বেলা করে" এলো। আরও আগে আসলে হয়ত তীব্রভাবে অনুভব করা যেত (?) ।
অর্থাৎ
যার আগমনের জন্য কথক অপেক্ষা করছেন - তার আগমনটাও কিন্তু খুব
তীব্র আনন্দদায়ক কিছু না। ততদিনে স্পষ্ট হয়ে গেছে আগমনকারীর চেহারা। কিন্তু অদ্ভুত
ব্যাপার হলো - তারপরেও তার জন্যে
অপেক্ষা করছেন কথক। একটা অদ্ভুত বৈপরীত্য। যাকে চাই - তাকে চাইছি - তীব্রতা যেন নেই - কিন্তু তারপরেও চাইছি। এদিকে, অস্পষ্টতাই যেন ভালো ছিল, তারপরেও স্পষ্ট করে পেতে
চাইছি।
এখানেই
এই কবিতাটি 'হৃদয়পুর' কবিতার সেন্স টাকে একভাবে অতিক্রম করে আসে বলে মনে হয়। হৃদয়পুরে আমরা
সেই 'জটিলতার' আর 'আকাশে আধোলীন' অস্পষ্টতায় বাস করছি। সেই
অস্পষ্টতার , বিরহের তীব্রতা আর
সৌন্দর্য টের পাচ্ছি - ওখানে কথক শেষ পর্যন্ত
বলছেন - "কী কাজ তারে ডাকিয়া আর"?
কিন্তু
কলিংমনে সেই কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি দ্বিতীয়বার চলে এসেছেন কিন্তু আমি কথক কিরকম
নিরাসক্ত হয়ে উঠছি। নিরানন্দ, ক্লান্তিকর, তারপরও আকাঙ্ক্ষা। একটা
মিশ্র, বিপরীতধর্মী অনুভব।
এটা
মনে হয় আমাদের এখনকার সময়কে আরও ভালোভাবে ধারণ করছে।
কারণ, কেউ কেউ যেরকম বলে থাকেন, আগের যুগের মানুষেরা
প্রেমের পূর্বরাগ, বিরহ, মিলন আরও তীব্রভাবে পেয়েছেন, কিন্তু আমরা, যে কারণেই হোক, হয়ত টিভি মিডিয়ার কারণে, হয়ত ইমেইল, হয়ত সামাজিক মেলামেশায়
সাবলীলতা - যে কারণেই হোক – আমরা সেই তীব্রতা অতখানি পাইনি।
আগের চাইতে আরও স্পষ্ট কালে বসবাস করছি যেন।
পূর্বরাগ, বিরহ, মিলনের অনুভূতি তেমন ভাবেপাওয়ার সুযোগ নেই। বিরহের আগেই প্রাপ্তি।
কিন্তু আকাঙ্ক্ষা আর প্রাপ্তির এই মিলিত অভিজ্ঞতায় বৈপরীত্য আছে, নিরাসক্তি আছে, কলিংমনের জন্যে অপেক্ষা
আছে।
গোলক মোচন
এই
লেখাটি খুব নিরেট একটা কবিতা মনে হয়েছে। এই অর্থে যে - কোনো অংশ আলাদা ভাবে তুলে আনা
যাচ্ছে না। যেন পাথরের তৈরি একটা ভাস্কর্য।
এটা
বেশ কৌতূহলের একটা বিষয় বলে মনে হলো। মূল যে কবিতা ছিল - তা একটা মিথোলজি ভাঙ্গা কবিতা।
গ্রিক মিথোলজির ডেডেলাস / ইকারুসের কাহিনীকে নিয়ে শামসুর রাহমান একটা কাব্যের
ভাষ্য তৈরি করলেন। ভাষ্যটা এরকম যে - মুক্তির আলোর দিকে এগিয়ে
যাওয়া চেতনার কাছে নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাওয়ার ইচ্ছাগুলি ম্লান হয়ে আসে।
সম্ভাব্য পরিণতি বিয়োগাত্মক হলেও - মানুষ অনেকসময় সেই
বৃহত্তর মুক্তিকেই যেন বেশি আকাঙ্ক্ষা করে থাকে। মুক্তি এখানে আলো, কিংবা সূর্য।
অথচ, এখানে এই 'গোলকমোচন' কবিতায় সেই আলো বিষয়ক
ভাষ্যের সূত্র ধরেই যেন বা - খোদ আলোকেই অন্যরকম করে
তোলা হলো - আর সেই 'অন্যরকম আলো'কে ভিত্তি করে নতুন
একটা মিথোলজি তৈরি হবার দিকে আগালো যেন।
নতুন
মিথোলজি বলছি কারণ, "কৃষ্ণলোক", "মহারূপের দুই জমি",
"মজমজার হাট", "বিচিত্র ষাঁড়",
"সচিত্র মানুষের লিঙ্গ", "বিশ্বলোক",
"মোমের কাজ", "মোমের কারিগর",
"অর্ধষাঁড়", "যুদ্ধে পড়ার আলো"
- এই শব্দগুলো যেন একটা নতুন/ভিন্ন মিথোলজির
পরিবেশ বুনন করে যেতে থাকে। সেই সাথে কবিতার কিছুটা মন্দ্র ভাষা বা সুর সেই মিথোলজি-ভাবনাকে সাপোর্ট করে।
ইকারুসের
আকাশে যা ছিল উপরে ওঠার "স্পৃহা", তা গোলকমোচনে হয়ে গেল, সুতোর টান ধরে ছুটে আসা "ইন্ধন"। আমরা আলোর দিকে ছুটে যাচ্ছি না, বরং "সুতো ধরে নেমে যাচ্ছে আলো"। যেখানে, নিচে, বিশ্বলোকে মোমের কারিগর - (অর্থাৎ, যেমন ইকারুসের পিতা ডেডেলাস মুক্তির স্বাদ দেবার জন্য মোমের দ্বারা পাখা
জুড়ে দেবার কাজ করছিলেন) - সেই মোমের কাজ বা মোমের কারিগর
বিশেষ কেউ না, বরং অনেকের মধ্যে এক। আমরা এত দূরে চলে এসেছি যে - এহেন মোমের কারিগর ও আমাদের কাছে অনেকের
মধ্যে এক। উনি বিশেষ কিছু না।
দুটা
কবিতায় দূর থেকে দূরে চলে যাবার একটা ভঙ্গি আছে, গতি আছে। কিন্তু দুটা
কবিতার মধ্যে স্বাদের কিরকম পার্থক্য! ইকারুসের আকাশে একধরণের পজিটিভ
আলো (সূর্য) শামসুর রাহমান প্রতিষ্ঠা
করেছেন, কিন্তু সেই আলোকেই কবি সব্যসাচী হাজরা ভিন্নতর একটা রূপ দিয়ে ভিন্ন
মিথোলজি গড়ে তুলছেন যেন। এই আলো মুক্তির আলো নয় বরং, এমন আলো, যা যুদ্ধে পরার (পরিধান করার), যা সূর্য ডোবার।
কেন
যেন মনে হচ্ছে - এটা ইকারুসের 'মৃত্যু-পরবর্তী' হতাশার অনুভব। যদিও আমার এই বক্তব্য সমর্থন করার পিছনে কোনো যুক্তি
আমার নেই। কিন্তু পাঠক হিসাবে এরকম একটা অনুভব আমার কাছে আসল। এটা যেন ইকারুসের
ঘটনাকে আরও এক ধাপ অতিক্রম করে যাওয়া। এখানে ইকারুসের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা
অন্যরূপ নিয়ে এসেছে। কবি-কথকের নিজের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা এসেছে, কিন্তু সেগুলা ইকারুসের অভিজ্ঞতার মত অতি-নির্দিষ্ট নয় – বরং ইচ্ছে করেই অভিজ্ঞতার উপর
থেকে কবি যেন তাঁর অধিকারগুলো ছেড়ে দিয়েছেন। অভিজ্ঞতাগুলা যেন ‘অনেকের মধ্যে এক’।
এই যে ভেঙ্গে ফেলে পুনরায় গড়া, পরিচিত শব্দগুলোকে আর assumption কিংবা স্বতঃসিদ্ধ ধারণাগুলোকে ( যেমন, আলো) পুরনো প্রেক্ষিত থেকে বের
করে এনে - নতুন প্রেক্ষিতে বসানো - পরিশেষে ভিন্ন এক উপসংহারে
পৌঁছানো - এটাই সম্ভবত বিনির্মাণের
কাজ। খুব সুচারু ভাবে কবি সব্যসাচী হাজরা যা করেছেন । বিভিন্নভাবে করে দেখিয়েছেন।
উনার রচিত তিনটা কবিতাই - বিনির্মিত হলেও - স্ব-গুণে, স্বতন্ত্র কবিতা হিসাবে জ্বলজ্বল করে চলেছে। পূর্ণাঙ্গ কবিতাগুলা
আলাদাভাবে পড়ে তাদের পূর্ণ স্বাদ নিতে মোটেই সমস্যা হবে না কারো। পাঠক পাঠিকা-মাত্রই সেটা বুঝতে
পারবেন। ধন্যবাদ।
সব্যসাচী হাজরা-র প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা
প্রণয়ধ্বনির সফ্ট্ওয়্যার ।। বারীন ঘোষাল
বিদ্যুতটি উঠতে গিয়েও পড়ে গেল পায়ে
খোলা সারা গায়ে
ভাবনা আর ছাড়িয়ে পেলো না মাথা
এই স্থির বিদ্যুৎ স্থির মানুষের চুল
কিছুই হারালো না দীনদীন কাশ অবকাশ
চোখের ভেতরে থেকে গেল সব মেঘ
চাঁদ আজকে হাফপ্যান্ট পড়েছে
মুন হরমোনে তৈরি হচ্ছে মানুষদের মধ্যে আমার মিছিল পা
খোকা চাঁদ নড়বড়ে হাঁটছে তুফানশিল্পের দাগগুলোয়
আন্তর্জাল আর হাহাকার লুকোচুরি খেলছে
মন ভারি হয়ে এলেও দেখে সুখ
কটকের বিদ্যুৎ অসুখ
মাছরা তো এখন ফুটবেই কার্টুনে
ফুটবে চোখের চমক ফিন ফিন ব্যাকুল বিশ্ব
এবং সূ্র্যের উল্টোদিকে আসবো একদিন
প্রান্তর ফান্তর মনোরমাকে পালটে দেখা মারনোম
রবীন্দ্রনাথ ।। বিনয় মজুমদার
তবে তো রবীন্দ্রনাথ আশা আছে, তুমি আছো কলকাতা থেকে দূরে গ্ৰামে
যেখানে সমস্যা আর সমাধান পাশাপাশি শুয়ে থাকে প্রকৃতি রয়েছে।
ব্যর্থকাম চিমনির গ্লানি রোজ আকাশের রাঙা গালে কালিমা লেপন
সেখানে করে না; তুমি শিখেছ কেমনভাবে কথা বলে বিবাহিতা নদী।
এত জল নিয়েও সে অতি অকপটে চায় কার্তিকের কিছুটা শিশির।
তুমি সেইখানে থাকো নদীর ভিতরে, তীরে কাশবনে হাত বোলাতেই
দেখা গেল তুমি এক বিরাট পুরুষ আহা হাজার মাইল লম্বা, তবে
তোমাকে তো এখানেই থেকে যেতে হবে এই গ্ৰামাঞ্চলে মরণ অবধি।
তোমার অভিজ্ঞ ছন্দ, হৃদয়ের রস যারা মুখোমুখি বসে পায় তারা
তোমার কবিতা বোঝে, শুধু তারা - এইসব নভোচরী ধবল বলাকা।
এদের রটনা শুনে শালিকেরা দায় পড়ে মেনে নেয় তুমি এক কবি।
কে না জানে পৃথিবীকে খুব বেশি দূর থেকে অন্য গ্ৰহ থেকে দেখলেই
একটি নক্ষত্র বলে মনে হয়, এই সত্য চিরদিন মনে করে রেখে
কী যেন করেছ তুমি- এই বলে শালিকেরা আরো দূরে সরে যেতে যেতে।
কোন দরজায় প্রথম নক করতে হবে ।। প্রদীপ চৌধুরী
একটা নিটোল মুখের কথা ভাবতে ভাবতে
আমি শীতের বিছানা ছেড়ে নেমে আসি ডিসেম্বরের মাঠে
ঠাণ্ডা জঠরের ওপর পা ফেলে
আমার পা শহরের নীচের নদীর মতো
থেমে যায়
আমি জানি না কোন দরজায় প্রথম কড়া নাড়তে হবে
জানি না এত দুর্বল পৃথিবীর ওপর মানুষ কি করে ঘুমোয়
স্থির হয়, নাক বরাবর ঘুসি মারার ইচ্ছা দ্বিগুণ বেড়ে উঠে -
এ ছাড়া আমার কোন উপায় নাই, আমার আয়ু
এর উপর নির্ভর করছে আমার জননক্ষমতা, আমার
মমতা ও ঘৃণা, আজ সময় হয়েছে
প্রতিটি বালিকাকে পরীক্ষা করে দেখার
কভার খুলে প্রতিটি বাজেয়াপ্ত বই
কতটা ভালবাসা পেলে মুখ নিটোল হয়, কতটা বাতাস
খেলে মানুষ ভালবাসে
আমি জানিনা উঁচুতে ওঠাতে পারছিনা মুখ, ও মৃগয়া -
প্রার্থনা করি তার জন্যেও, একা, উবু হয়ে থাকি
দীর্ঘ কুয়াশায় গলে যাচ্ছে শরীর
কোটি খুনীর দুঃখ আমার সামনে আয়ুর মত দীর্ঘ
বিনির্মাণ করলেন রাদ আহমদ
প্রলামেম ।। রাদ আহমদ
'মারনোম' থেকে মনোরমাকে দেখতে গেলেই দিন দিন শুধু
ভণিতা মাখিয়ে খালি গা হয়ে বিদ্যুতে আমি তুমি ও বাজারে
মাছ-ওলা নাকি ছেলেকে নিজের বাহরাইন
বিদ্যুতে ছেলে কথা বলে, হাসে বিদ্যুতে নীল কিরকম তুমি
আচমকা শুধু জ্বলতে থাকা শরীরে ফসফরাস
স্থবির হলাম কথা ফুরালাম দীন দীন ভণিতাকে পাঠালাম
প্যাকেটে প্যাকেটে জালের গায়ের গিটগুলা আমি
ঐ পাড় থেকে দেখ দীনতার পোড়ানো পাতার
চুরুটে তামাকে গুড়া পাতাগুলা কুঁচকে উঠেছে যে ভ্রু জোড়া সাথে
শুষ্ক আমাকে দেখ আসলে বরফ বদ্ধ মাছ
কার্টন থেকে ছাড়ানোর কালে নখের গায়ের মসৃণতার মতন তোমার
মোবাইল স্ক্রিনে ভণিতার ওম যাচ্ছে না ঘসে তুলে ফেলা হাত
মাথা ও নখের থেকে
সূত্র: প্রণয়ধ্বনির সফটওয়্যার ।। বারীন ঘোষাল
সানগ্লাস ।। রাদ আহমদ
উড়ন্ত বকের সাথে ক্রম অপসরমাণ শালিখেরা থাকে একই সাথে
দেখি বিনয়ের সাথে কোলকাতা থেকে দূর গ্রামে
সেখানে রবীন্দ্রনাথ সাদা শিশিরের টুকরা টুকরা স্পৃহা কি হয়েছে আসলেই
সুবিশাল চেহারায় ধরে রাখা ক্রম অপসরমাণ
হতাশা ধারণ করা বিবাহিত নদীদের প্রচণ্ড বিস্ময়ে দেখি
কাশবন থেকে বিচ্ছুরিত ছন্দগুলা সূত্রায়িত করা সে মহান মানুষেকে
তারুণ্যে লন্ডনে দেখি নাচের ফ্লোরেতে সামাজিক নানা অকেশনে সিনথেটিক ড্রাগস
তখনও সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করেনি মেয়ে তার অল্পকাল পরে এসেছিল হিরোইন যার পরে আরো হতাশা মুখর উত্তেজক ড্রাগস আচ্ছা 'ডগিং' কি এসেছিল শহরের
গাড়িতে গলিতে বিবাহিতা হতাশারা ক্রম অপসরমান
বিপন্নতায় নারীকে তাই টেলিফোনে দেখি মাঝে মাঝে চোখে কালো সানগ্লাসে কবিদের দেখি
চশমার কাচে জমা শিশিরের ফোঁটা নিয়ে কোলকাতা থেকে দূর গ্রামে
সূত্র: রবীন্দ্রনাথ ।। বিনয় মজুমদার
প্রগাঢ় জবা ।। রাদ আহমদ
একটা সজাগ ফুলের মিষ্টি সপ্রতিভতায়
ক্রমাগত ঘুরছি নীরব শহর। একটা গাড়ির
পেছনের সিটে কালো চামড়ার সিটের উপর পবিত্রতায়
দেখি যে কালো মানুষ নাই মানুষ নাই তবে মানুষত্ব আছে যেমন
কুকুরের পিছে লুকিয়ে থাকে কুকুরত্ব একটা গ্লাস
জুসের যদি-বা অর্ডার দাও তাইলে তাকের উপর থেকে
যেখানে রাখা আছে জুসত্ব সেখান থেকে বারটেন্ডার
কিন্তু আসলে তো কেউ নাই তোমাকে
দিবে যা বিনা প্রয়োজনে এমনকি যে গাড়িতে তুমি
বেড়াচ্ছ ঘুরে সেটারও তো কোনো চালক নাই একা
একাই চলছে প্রথমে নক করব যার সাথে সম্ভাব্য
বিয়ে ভেঙ্গে যায় আত্মীয়ার এক অবস্থাশালী সুন্দর এলাকায়
ওখানে আম গাছ অনেকটা নিচু হয়ে ফোটে
ছায়া দেয় গেটে। গায়ে হলুদের আয়োজনে নানা
কমলা সিলোফেন
প্রগাঢ়ত্ব নিয়ে আমরা জন্ম নিয়ে সেটাকে একটা একটা
প্রগাঢ় জিনিসে রূপান্তরিত করে লালচে জবা ফুল
শহর জুড়ে জবা নিয়েই নক করব
দরজা দরজায়
সব্যসাচী হাজরা
যেখানে বিদ্যুৎ আশ্রয়। স্থির বিদ্যুৎ, চার্জ জমছে কোথাও। মনে পড়ছে ট্রাইবোইলেকট্রিক সিরিজ। মনে পড়ছে মানুষের চুল। মেঘ থেকে তড়িৎ পড়ার কথা। আমাদের মনোরমা উলটে গিয়ে মারনোম। আর সেখান থেকেই শুরু প্রথম লেখার নির্মাণ → নির্মাণ। এর ভূগোলে এর গোলে ভূতপূর্ব মানুষের অভূতপূর্ব পিন তার। তারে তারে তরল হচ্ছে মুখ। তাইতো স্থির হওয়া আর ভণিতাকে পাঠানো। “Electricity is really just organized lightning”... -Gerorge Carlin. হাসি, কান্নার বিদ্যুৎ। চলমান ছেলে মেয়ে, চলমান ঘর্ষণে তুমি ও সে। ঘষে তুলে ফ্যালা নখ। যদিও আমি স্থির।ঘষার ভণিতা পাঠাও। চলার ভণিতা পাঠাও। মাছ ফোটার পর শুষ্ক বরফবদ্ধ যারা তারা কার্টুন থেকে কার্টেনে ওহো মারনোম থেকে আমাদের মনোরমা আমরা খালি গায়ে, খালি পায়ে চাঁদ নেই। চাঁদের হাফ-প্যান্ট নেই। চুরুটের ধোঁয়া চুরুটের ধোঁয়া …
রবীন্দ্রনাথ আজ ঘর্ষণে চলমান। তাই বিনয় নিয়ে টপকে গেলেন রাদে। বক ও শালিক প্রয়োজন মাত্র, প্রয়োজন মাত্র অনেক দূরের। সহজপাঠ রাখার প্রয়োজনে। ভাসনের শর্ত নেই রবীন্দ্রনাথে। তাই কি নির্লজ্জ ভাসান? হা হা এই আমাদের অস্থিরতা, আমাদের মাদক, স্ল্যাং, ল্যাং অনুস্বর আমাদের হ্রস্ব দীর্ঘ, নাকি কাউকে কাছ থেকে অনুসরণ করা। নাকি প্রকাশ্যস্থানে যৌনতার টিপছাপগুলো। তবেই তো রবীন্দ্রনাথ আশা থেকে হতাশায়। বিবাহিতা নদী থেকে বিবাহিতা দীনতায়। কালো কাচে দেখে নেওয়া রোদের নিম্নহলুদে আমাদের চোখ শিশিরের ফোঁটা নিয়ে কবিদের দ্যাখে। দূরে গ্রামে ব’সে শহরের ঘুলঘুলিগুলো। “In the mountain, stillness surges up to explore its own height In the lake, movement stands still to contemplate its own depth”… তাইতো তিনি হাজার মাইল লম্বা।
আত্মীয়া বিবাহিতা নয়?কালো চামড়া, কালো মানুষ, মনুষত্ব, কুকুরত্ব, জুসত্ব তাই নিয়ে হারাগিরি আমাদের। খুঁজে চলে দরজা। একা একা একা নক করার আলো হাতে নিয়ে। মুখ না ওঠাতে পারলে আম গাছ নিচু হয়েই ফোটে। মনুষত্ব? ওহো এই অস্থির খোঁজ। শহরের নীচে থেমে যাওয়া পা → ক্রমাগত ঘুরছি নীরব শহর। হলুদ কমলা লাল। রক্তিমতা নিয়েই ব’লে ফেলি “Is there anybody there”? মানুষ… মানুষ খুঁজতে খুঁজতে প্রগাঢ়ত্ব আজ মাথা তুলে টোকা দ্যায় চালকের গায়ে। তাকিয়ে দেখি চালক নেই, আমি ব’সে আছি।