বাক্সবদল- ৬





নির্বাচিত দুই কবি, একটি জুটি। বেছে নিলেন প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা। বদলে দেওয়া হল বাক্স।
একে অন্যের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণ করলেন। আবার বাক্সবদল।
নিজের প্রিয় বা পছন্দের তিন কবিতার বিনির্মাণ / পুনর্নির্মাণের আলোচনা করলেন এক কবি।
অন্য বিনির্মিত কবিতাগুলির আলোচনায় আমাদের সহায়তা করলেন- নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কবি।

প্রদীপ চক্রবর্তীর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা

ফেরার বোতাম-১ ।। কৌশিক চক্রবর্তী

সেতুর বিকেল গুনে গায়ে হলুদের টানগুলো
                        আলো হল।
গল্প লিখছে      কুয়োতলার ঘরবাড়ি
                ঘরবাড়ির হরিণ
                হরিণাহরিণী

পাউডার মাখানো রাস্তায় আরাম নামলো খানিক।
তারের বারান্দারা পাখি হলে
আমিও পেরিয়ে যাব ছায়াদোলনা...

জামার আজানে দোভাষী ব্যাখ্যা ভিজছে।
ছিটকিনির বোতামঘর থেকে
টুকি দিল রেললাইনের গৌরীবন -
বাড়িপক্ষের জলগুলো আজ যেন
চাঁদ হয়ে দু-একটা
                দুঃখ গেয়ে যায় 


ফেরার বোতাম-২ ।। কৌশিক চক্রবর্তী

সবুজ রানওয়ের ট্রেন
                সন্ধের তুলোয় ম’ ম’ ...
গলিছুট ত্বকের ছিটমহল
গুঁড়ো গুঁড়ো দেহাতির বর্ষা গাইছে।
গা-ভার নদীদের ননদিনী
                বাঁশি লিখে
কুড়িয়ে নিল কিসসার বাগান।
একটা ধ্বনির বিরহ তার কেটে ক্রমশ বড় হচ্ছে।
আঁচলের গোলাপি থেকে একে একে বেরিয়ে আসতে চায়
খানিক লালচে মানে দেয়া নেয়া
যাতায়াত খোলা হলে রঙ বেপরোয়া নাম নেয় -
গাছতলায় ফকিরির ঝোলা পড়ে আছে।

        সিড়ির ভাজকপাল থেকে তার গান নখ কাটে।
        একটা সাইকেল বসলো ওপাশে।
        আস্তে এবং আসতে শশীর আয়নায়
        ছাতার আবছায়া তারপর নখরাঙানো
        যামিনী।

        ছোট ছোট ক্রিংয়ে দেখো
বিলি কাটছে
অনেকগুলো কতরকম মানে


ফেরার বোতাম-৩ ।। কৌশিক চক্রবর্তী

মেঘের টিলা ফুরিয়ে যাওয়ার পর
এইবার রং মাখছে বেলুন।
ভিজে দেখেছি। জিভে তারা ফোটে...

সাদা সাদা ঘুমকেমনের বাক্সে
দুপুরের ছুটিগুলো আশনাই।
সাইকেলের ব্যাকসিটে কী ধ্বনি যে বানালো
এই ফেরার বোতাম

জ্বর ছেড়ে আসা এই সরলরেখায় কোনো আত্মকথা নেই
চোখের মলমে সন্ধে এসে মাঝেমধ্যে রুমাল ওড়ায় -

বৃষ্টির কাফেটেরিয়ায় আদর তার বানান ভুললে
অনেকগুলো অনন্যর ফাঁক দিয়ে দেখা যায়
আমাদের নৌকোগুলোয় পতপত করা
রঙবেরঙের নাম ও নিশান...


বিনির্মাণ করলেন দেবাদৃতা বসু

ফেরার বোতাম-১ ।। দেবাদৃতা বসু

সমস্ত পোশাক খুলে ফেললে চাঁদ হয়ে ওঠা যায়
শরীরের ভেতর বিকেল নামছে ক্রমশ
এই জ্বর
বুকে তুলে কোলাকুলি করি
আর জামার বাইরে এক একটা ঈদ পেড়িয়ে যায়।
ঘরবাড়ি পরে থাকবে কুয়োতলায়
ইটের বিনিময়
ছোটদের দুধ মিশবে জলে।

সূত্র: ফেরার বোতাম-১ ।। কৌশিক চক্রবর্তী


ফেরার বোতাম-২ ।। দেবাদৃতা বসু

যে লোকটা ট্রেন হয়ে গেছিল
তার কাছে দুয়া চেয়ে নাও।
চোখের বাইরে বড় হচ্ছে পৃথিবী

সন্ধে নামলে রোজ হাতকড়া পরি
আর নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়ায় একটা জনপথ
রাস্তার যত ভাঁজ হয়ে যাওয়া
লাগাতার ক্রিং ক্রিং নোটের সাথে
তার ভেতর দিয়ে
গলে হয়ে যাচ্ছে ক্রিম
এক একটা আইসবার্গ পরে যাচ্ছে কাঁচের গ্লাসে।

সূত্র: ফেরার বোতাম-২ ।। কৌশিক চক্রবর্তী


ফেরার বোতাম-৩ ।। দেবাদৃতা বসু

মেঘ ফুরিয়ে যায়
আর রঙ
এমনকি বোতাম থেকে ফেরার হয় জমে থেকে স্মৃতি
একটা বাক্সের ভেতর বসে মানুষ কাটি
রক্ত জমে উঠলে
প্রয়োজন হয় নতুন বাক্সের।
বাড়ছে খুলে রাখা পোশাকের সংখ্যা
যত না মানুষ তার থেকে বেশি
যেন পোশাক খুলতে গিয়ে গিলে ফেলেছে সমস্ত বোতাম
আর বৃষ্টি আসার অপেক্ষা
ছোট ছোট জলে
ভাসিয়ে রাখা নৌকার নাম দেবে বলে।

সূত্র: ফেরার বোতাম-৩ ।। কৌশিক চক্রবর্তী


দুই কবির কবিতা নিয়ে কিছু অনুভব ,কিছু ভাবনা...

প্রদীপ চক্রবর্তী 

কৌশিক চক্রবর্তীর মূল কবিতা পড়ে যা মনে হলো... 

।। সেতুর বিকেল ও গায়ে হলুদের টান ।।

       কুয়াশা ভেজা একটা ভোর। ডিসেম্বরের শীত। নস্যি রঙের আলোয়ান মুড়ে বসে আছে একটি বিগত দশকের জল রঙে আঁকা কিশোর। মুখে শীতের ধোঁয়া। মনের অজানিত সম্ভাবনাগুলো ইচ্ছেপূরণের গল্প হয়ে ওঠে। সে দেখেছে কি ভাবে রিং মাস্টার , ছোট চারমিনারের প্যাকেট থেকে তাজা সিগ্রেটের ধোঁয়া নিয়ে তৈরী করে ধোঁয়ার চক্রব্যূহ। আস্তে আস্তে ওড়ায়। সেতুর ওপারে কনে দেখার আলোয় হলুদের বিগত বসন্তের চারমিনার আন্ডারগ্রাউন্ড সাহিত্যের খোল নলচে বদলে দিতে চায়। দিন বদলের গল্প লেখে ধোঁয়ার আলোকিত মিঠে কড়া। একটা পানঘুমটির অলক্ষ্যে পুড়ে পুড়ে নারকেল দড়ি সাফা হয়ে যায় কখন , কেউ খোঁজও রাখে না রাখে নি রাখবে না কোনোদিন ...

।। গল্প লেখা ও কুয়ো তলার ঘরবাড়ি ।। 

       আসলে গল্প লেখা হয় না। গল্প লিখিত হয় না। গল্পের লেখার মতো কখনো কোনো খাতার পাতায় অবশিষ্ট কালির আঁচড় , থেমে থাকে না। ভাবনাগুলো পরিপূরক স্বপ্নের শূন্যতায় বে-হদিশ বে-সমাজ বেফিকির মনে মনে ঘোরা শরণার্থীর মতো !

       আসে আজো ভাবনাগুলো আমাদের ইচ্ছেপূরণের ডানায় ভর করে। অথচ শব্দ পায় না নিখিল বিস্তৃতি। শব্দ হাতড়ে , ধ্বনির সাংকেতিক ইশারায় , লিপির গ্রন্থিত বর্ণসংস্থাপনে আজো খোঁজা থামে নি। 

       সেই অদৃশ্য দরজাটা, যেখানে দাঁড়িয়ে আছে আলাদিন ও তার ইচ্ছে পূরণের দৈত্য হয়ে,  লালকমল নীলকমল বামন - এর দেশ ,তেপান্তর হট্টমেলার মাঠ পরীপিসি চম্পা বোন। দূরদেশের সমূহ চাঁদোয়ার ভেতর ভেসে ভেসে আসা একটা গানের মতো অস্ফুট গান হয়তো ,কিশোর কুমারের .....তারে আমি চোখে দেখি নি / তার অনেক গল্প শুনেছি / গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালোবেসেছি .....

       এই নাগরিক জীবনের চাপা বেদনা আর হারানো কথারূপ নিয়ে , মনের বাষ্পাকুল চলিষ্ণু এক শরণার্থী ছায়া ফেরি করেন , এক অজানিত ব্যথার প্রগাঢ় অনুভবের গহনে রক্তাল্পতা যে অশনি সংকেত বহন করে আনে আজ , সেই ভাবায় ভাবিত যেন এই আনমনা শেষ প্রহরের ঘুমহীন কবি। যার শৈশব সত্তরে ,কৈশোর আশির দশক এবং যৌবন নব্বইয়ে ....। যে একইসঙ্গে শাদা কালো সাটার লাগানো ইয়াব্বড় টিভি দেখেছে। একইসঙ্গে অধুনালুপ্ত ছয় ব্যাটারির রেডিও। রেডিয়োয় শুনেছে বিনাকা গীতমালা , বোরোলিনের আসর ও শীতের জমানো দুপুরে আলতো ন্যাকা মিষ্টি কন্ঠী শ্রাবন্তী মজুমার। ইডেন উদ্যানে শীতের দুপুরে ক্রিকেটের ধারা ভাষ্যে , অজয় বসু , পুষ্পেন সরকার , সুকুমার সমাজপতি। ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান লীগের খেলা ,কুমোরটুলি থেকে ভাতৃসংঘ। পাড়ায় পাড়ায় বাঙাল ঘটির লড়াই। কাইট্যা ফেলুম , আমি যে সে নই , ঢাহার পুলা ...!

       একইসঙ্গে খেলার মাঠ , শীতের ক্রিকেট ,যখন মাথা তুলে দাঁড়ায় নি সাইবারকাফে। অপরাধ বিজ্ঞান। কেবল শশধর বা মোহন সিরিজ , স্বপন কুমার , কাকাবাবু , ফেলুদা , ঘনা দা , টেনি দা , কিরীটি , ব্যোমকেশ , নারায়ণ দেবনাথ ও দেব সাহিত্য কুঠির ..., বাঁটুল দ্য গ্রে ট , হাঁদা ভোঁদা , নন্টে ফন্টে , চাঁদমামা , আনন্দমেলা ,কিশোর ভারতী। শৈশব শরীফ। লুকিয়ে পাতা ওল্টানো সিনেমার জগৎ , স্বপন কুমার ওরফে শ্রী ভৃগু , নবকল্লোল , প্রসাদ ,উল্টোরথ। রাত জেগে ডোভার লেন ও সুমনের গান। গৌতম মহিনের ঘোড়া কিংবা রঞ্জনপ্রসাদের গানে , বা পীযূষকান্তির কেন তুমি চেয়ে আছো মা মুখপানে ... হা হা  নতুন নব্বইয়ে নতুন করে রেজারেকশন ...!

জাম্বো টেলিফোন। ট রে টক্কা ট রে টক্কা টক্কা টক্কা ট রে ট রে .....। 

       মহিলামহল , বেলা দে। গল্পদাদুর আসর - পার্থ ঘোষ। কলকাতা ক - এর নাটক। দেবদুলাল , নীলিমা সান্যাল , বরুণ মজুমদার , তরুণ চক্রবর্তী। অন্যদিকে , শোভনলাল , শুক্লা বন্দ্যোপাধ্যায় , জগন্নাথ বসু ও উর্মিমালা বসু। অজিতেশ ,কেয়া চক্রবর্তী ,বিকাশ রায় ,সত্য ব্যানার্জী, তরুণ কুমার কিংবা শম্ভু মিত্রের নাটক এবং অবশ্যই জ্ঞানেশ কিংবা অশোক মুখোপাধ্যায়। নবইয়ের যুবক যেন জীবনের হারিয়ে যাওয়া একটা শতকের শেষ এবং আরেকটা শতকের শুরুর যুগসন্ধিতে দাঁড়িয়ে দেখছে কত অজানারে।

       সেই গল্পের ভোরে আমিও আছি কোথাও। আমিও আজ খুঁজে চলি আমার হারানো শার্টের বোতামঘর। সেই আজান। সেই পড়ন্ত বিকেলের রেললাইনের খোলামে গৌরীবনের গন্ধ। সেই বাড়ি ফেরার এক নয়া শতাব্দীর নাগরিক শরণার্থী। যার দেশ নেই। সমাজ রাষ্ট্র থেকেও উদার অর্থনীতির সংশয়ে কাঁটাতারের মতো অজানিত ভবিষ্য। শিকড় অভিমান বনান্ত। এক পশলা তিতাস বা ন্যংটোপুটো সেই সেই সেই ছেলেটি........

       যার বৃষ্টিতে গান গায় সিলভিয়া প্লাথ। অধীর বিষাদ প্রতিমায় শরণার্থীর পতনোন্মুখ কলসেভরা দ্বৈপায়ন ....

       আসলে কবিতায় সেই চেতনাতিক্রান্ত ভ্রমণকে খুঁজি ফিরি আজ ও। যার স্টেক নেই ,দ্বন্দ্ব নেই , পিছুটানের গল্পে আছে কাল্পনিক যাপন ও জীবন অভিজ্ঞতার মিলিত রসায়ন। এই তো দ্বৈত আমার  আলোর কথা এবং কৌশিকের, ফেরার বোতাম .....

       এই ইচ্ছে পূরণের গল্প নিয়ে শুরু হয় , কিংবা পথের মাদকতায় ভ্রামণিকের কিংবা নাগরিক বাউলের পথ চলা। একটা বহুরৈখিক ডিসকোর্স। একটা আত্মখননের নিহিত পাতাল ছায়ায় সন্ধিৎসু জীবনের কয়েক পশলা ...।

       এ ফেরা গুলোই ফিরে ফিরে আসে নানা ভাবে। বস্তু ও নির্বস্তুর , জড় ও জৈবিকের  সূক্ষ্ম টানাপোড়েনে। ডানা মেলা বারান্দারা সর্বস্বান্ত শায়িত বুদ্বুদ পাখির মতো পেরিয়ে যায় ছায়া দোলনা। এক বিস্তৃত ব্যাপ্ত সম্প্রসারিত চেতনা বহু ক্লিশে ভাবনার মিথ গুলোকে ভাঙতে ভাঙতে পেরোতে থাকে ছায়া দোলনা। সবুজ অগণিত রানওয়ে। খেতি বাড়ির পাশে অস্ত উদয়ের ট্রেন। শহরের গলিঘুঁজি সন্ধ্যার গন্ধ মেখে তখন সেজে উঠছে এক দেহাতি বর্ষার নির্মীয়মান বিশ্ব বিধানে। যদিও সে বিধান কি  ও কেন  কবি ও আমি জানি কি ? ... 

       তখনো না জানা অপরাধ নয়। বিস্ময় বেঁচে থাকার অটুট ঘরানা। এতো মেট্রোপলিশ ইঁদুর দৌড় ....এতো ....এতো .... নাহ , নেই।

       আসলে কবিতার কোনো মানে নেই। অসংখ্য কল্পচিত্রের বসন্তরজনী , পীতপুষ্পরাগমনি কিংবা পাহাড়ের মাথায় ঘুরতে ঘুরতে দেখি যে ভাবে , বুদ্ধধর্মসংঘের ঘনায়মান শেষ বিকেল কিংবা প্রবাসের গ্রন্থিত বাসনা কুসুম ,ঠিক সে ভাবেই বিরহী এক নদীর ননদিনি। এক বিশ্ব ধ্বনির বিরহ। কবির সংগীত প্রীতি ও প্রগাঢ় সাংগীতিক বোধ ও ধীমান চরাচর। শান্ত উদার স্নেহের মতো আলো নিয়ে আসা জীবনের নানা রঙের অপ্রতিরোধ্য স্বপ্ন ও বিষাদের অনিবার্য উত্তরাধিকার। যেনো  আমাদের যে যার নিজস্ব চাঁদ ব্যবহারিক ,সচিত্র ও একফালি। তার শশী, এক এক বিন্দু সূচ্যগ্র অন্ধকার পেরোনো কাঙাল। মেঘ পল্লবিত। টিলার পর টিলা পেরোনো সেই অমল শৈশবের বেলুন ওড়ানো ব্রীহি।

      সেই স্কুল ফেরতা।  শেষ ঘন্টার ছুটি। সাইকেলের রোদ বাসা। নিরুদ্দেশের দিকশূন্যপুরে বুকের গোপন নিসর্গে আজগের কেজো পরাজিত মানুষটার সীমা ভাঙনের একমুঠো ঘুণ পোকা। এক অনন্ত এক অসীম এক সীমা শেষ হারা এফোঁড় ওফোঁড় ...

       যা হারিয়েছে আজকের রোবট পৃথিবী। কেরিয়ারের খোঁজে ইঁদুর পরিবার। বিড়ালের সুখী সুখী মু খোশ ফ্যামিলি। নব্বইয়ের মাঝ বয়সী আজো তাই এ তাবৎ স্বপ্নের পিছুটান ফেরাতে পারে না। কোনো কর্পোরেট বিপণন পণ্য সংস্কৃতি ক্রমাগত ভাঙনের তিল তিল ক্ষয় এই নিঃস্ব বুকের নীচে হৃদপিন্ড ছাড়াও আরো কিছু সম্বল আছে ,আরো আরো আরো আরো আরো কিছু প্রহর শেষে ..., 
যেন বুঝতে পারি এই কবিকে ,বৃষ্টির ক্যাফেটেরিয়ায় বসে।

       রঙ বেরঙের কাগজের নৌকো আজো রুপোলি ঝিলিক চুলের আড়ালে ভাসিয়ে দিই। বসতির ছেলেটি যে ভাবে মিড্ ডে মিল খাওয়া বাংলা মিডিয়াম থেকে ফিরতে ফিরতে হঠাৎ শহরের বর্ষায় বিলাবল বা খেয়া ময় শ্রাবণী বৃন্তে ফোঁটা দু ফোঁটা মেঘমল্লার বা মেঘান্তরের অসীম পারাপারে গিয়ে অথির বিজুরির নব ঘন শ্যাম কল্যানে গেয়ে ওঠে নষ্ট প্রজন্মের চাঁদ বেনে পালা ...


এরপর দেবাদৃতা বসুর ফেরার বোতাম গুলো ...

       একই শহরের ভেতরে বেড়ে ওঠা দুজন মানুষ। দুজন কবি। কৌশিক ও দেবাদৃতা। একই নাগরিক জীবনের শহুরে আদপ কায়দা মুখ ও মুখোশের গহন মুখ দুজনকেই দেখেছে। দেখেছে মুখ ও মুখর মুখের দ্বন্দ্ব। একই পথ ঘাট চেনা রাস্তা , মানুষের বিবিধ সুখ দুঃখ একাকিত্ব ও বেঁচে থাকার কৌশল প্রতর্কে তারাও এগিয়েছে , যে ভাবে মানুষ এক পা এগোয় আর দু পা পিছোয়।

       একই ক্লান্তি উৎসাহ স্বপ্ন। চেনা দুঃখ চেনা সুখ জনশূন্য পথে হাঁটতে হাঁটতে। অচেনা আপোষে। তাঁরা দেখেছে নিহিত অবশিষ্ট শৈশবের অশনি অন্তরালের বিন্যাস। অথচ দুজন মানুষ আলাদা আলাদা। প্রকৃতিদত্ত সত্যের নিরিখে। একই সময়ে একই শহর পৃথিবীতে বাস করেও দুজনের সংসার পৃথিবীর ভূগোল বিলকুল ভিন্ন।

       তাই , দেবাদৃতা বসুর ফেরার বোতাম , কবিতা গুলো নিছক বিনির্মাণ নয়। স্বতন্ত্র এক মানুষের ক্রম জায়মান ভাবনা ও অনুভবের হৃদি ও মেধা সন্নিবিষ্ট পুনরাবর্তনহীন নিরন্তর বহমান এক আকুল স্বপ্ন খোঁজ।

       বারংবার পোশাকের ভেতরে এক বিস্ময় বিভ্রমে অস্থির মানুষের নিজেকে অন্বেষণ নিজেকে খোঁজার প্রয়াস।

       মুখর পোশাকের কৃত্রিম আবরণ ছিন্ন করে শরীরের গহন হ্রদের কিনারে এক চাঁদ ঘোর যেন সেই আকুল আশ্রয় বিশ্বাস আঁকড়ে ধরে আতপ্ত কপালে মৃদু জলের ছোঁয়ায় একটু শান্ত নির্জন নগ্ন হাতের মায়াময় স্পর্শে বাঁচতে চায় শান্ত নিরুদ্বেগে। সেই স্বপ্নের অমল শৈশবের হাত ধরে ফিরতে , দুদণ্ড শান্তির প্রার্থনায় ক্রমাগত দূরে দূরে সরে যাওয়া জীবনের অন্য এক নির্জন সম্ভাবনার বৃত্ত টি সম্পূর্ণ করার অঘোর তমোঘ্ন তাগিদে।

       ঘরবাড়ি। কুয়োতলা। শিশুর ঠোঁটে লেগে থাকা ভোরের অপাপবিদ্ধ ঈষৎ দুধের ওম। কিংবা যে লোকটা কখনো বিষয়ী বাসনায় সফলতার পূরক চরিত্র হয়ে ওঠে নি আজো। আজো নাগরিক ড্রইংরুমের সীমায়িত নিষাদের ধৈবতে মেলাতে পারে নি নিজেকে। যাবতীয় ব্যর্থ বিপন্নতা আজো যার বিস্ময় গ্রাস করতে পারে নি , তাঁর ফিরে আসার জন্য ,সেই যাদুকরের প্রার্থনায় ,সেই শৈশবের রঙ বাক্স হাতে ,সেই বেহালাবাদক , সেই বেলুনওয়ালা , সেই পেটকাঠি মোমবাতি বগ্গার আকাশে ঘুড়ির ঝাঁকের পেছনে ওড়া ছেঁড়া গেঞ্জির ময়লা লাগা মুখের কিশোরটিকে নাগরিক বেদনায় পিষ্ট হতে হতে নিঃস্ব। এ কবির প্রয়োজন আজ  তাকেই। 

       এই বিপন্ন সময়ে এই তীব্র নাগরিক জনারণ্যে একা ক্রমশ ভিড়ের মাঝখানে একা হতে গিয়ে যে হারিয়ে ফেলেছে শিকড়ের ডানা , তাকে বড়ো প্রয়োজন এই কবির ...

       সেই কথা রূপ ,সেই রূপোকথার জগৎকে সেই ফেলে আসা উদাসী ফিটন ,সেই হারানো মন কেমন করা মায়ের মুখ , জন্মদিনের পোশাক , এক বিরল কাঠের পেটিকার মধ্যে রয়ে যাওয়া ভেতর ভেজানো তেপান্তরের বৃষ্টি বা ঝই ঝুপ্পুস ডুবে যাবার জন্য অবিরত পথের পুকুর আর ভাসিয়ে দেওয়া স্কুল ফেরতা কাগজের নৌকা গুলো ....একে একে...। হারানো অভিমান। হারানো কান্না। কারণ সেভাবে যন্ত্র মানুষের মন আর প্রাণ খুলে হাসে না ,কাঁদে না , এক স্তব্ধ নাগরিক মৃতের পাহাড়ে কেবল পুতুল নাচের কারিগর সখা !

       এই অসম্ভব ফেরার কাঙ্খায় ,এক আকুল হারানো লুপ্ত ধ্বস্ত সম্ভাবনাকে আবার কাল্পনিক চেতনার প্রসারিত দূরগামী মনখারাপের ভেতর ফেরাতে চায় দেবাদৃতার অক্ষর মালা। ফেরার ফেরিঘাটে আজান  বা ফেরার বোতাম গুলোয় লেগেথাকা সুতোর নিষিদ্ধ দাগ। পৃথিবীর মুখ ভরে ওঠে মৃদু হাসির ক্রমাগত সবুজ শৈশবের গন্ধে।

       আর এখানেই ,আলাদা হয়েও একাকার কবি কৌশিক চক্রবর্তী ও দেবাদৃতা বসু। এক কৈশোর পেরোনো রাস্তায় ,এক অতীত পেরোনো বিষাদে। রোগের রঙ  :  এক মৃত শহরের হাওয়ায় , বিলীন হারানো ট্রামের রেখায় ঝুরো পাতা বুকে তারা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে এক ভোরের মোহানায়।

        এক নতুন সম্ভাবনার আশায়। শুধু নাগরিক অক্ষরের পাথর ফসিল এলোমেলো শহুরে জটিল গলিঘুঁজি গূঢ় মেঘে ছাওয়া ডিপ্রেশন নয়।  এ অক্ষর নয় কেবল মৃতের স্তূপীকৃত শব্দ কঙ্কাল। সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে আত্ম বিভাজন আত্ম বিশ্লেষণ আত্ম প্রতিচ্ছবি নিঃসঙ্গ একক নিজের মুখোমুখি। দৃশ্যত সবই বদলায়। সব পাল্টে যায়। সবই হারায়। অথচ সব হারিয়েও হারায় না কবির স্বপ্ন দেখার পিপাসা। 

       তাদের অতল অন্ধকার আত্মঘাতী আলোর খোঁজে আজ এসেছে ,একাকার হয়েছে শব্দহীন উৎস কবিতার জীবন ও জগৎ পরিধির অসংখ্য দৃশ্য কল্পের ওতপ্রোত অথচ অটুট এক নিজস্ব অবস্থান থেকে ফেরার অব্যক্তে।

       পাঠক আমি। নিজেকে খুঁজে পাই দুজনের কবিতায় অনঘ অনশ্বর নিঃস্বনতার অবগাহিত বুদ্বুদ বুদ্বুদ শব্দে।

      যেখানে ফেরার সম্ভাবনা নিয়ে একটা হারানো শতাব্দীর ভগ্নস্তূপে দাঁড়িয়ে আমি ও আমাদের জনারণ্য  ....!

দেবাদৃতা বসুর প্রিয়/পছন্দের তিনটি কবিতা

আট বছর আগের এক দিন ।। নবেন্দু বিকাশ রায়

একটি উট জীবনানন্দ চিবিয়েছিল সারা রাত ধরে
যেন পটল চেরা দুঃখটি আসলে ফাঁকা জানলা
সমুদ্র এগিয়ে এলে জানলাটি গলে পড়বে জাহাজ দিয়ে। এসব জেনেও
                                                                একটি উট,
                                                                         একটি মুথাঘাসের কাছে
আট বছর আগে চিৎকার করেছিল

চাঁদটাও একধরনের সমস্যা হতে পারে
কীট তার উস্কানি গায়ে মাখবে বলে সঙ্খ খুঁড়ে রাখে
জারুল ঝুঁকে প'ড়ে জমানো ঘুম উগড়ে দ‍্যায় জলে; নিস্তব্ধতা এক ফ‍্যালাসি মাত্র
মলমল শব্দে
কেউ কেউ আলোর বদলে আমি লিখেছিল
প্রবাদ ফলেছিল নিশিডাকে

চমৎকৃত
বুকে হাত দিলে যেভাবে স্তন‍্যপায়ী ভাবো
     মনে করো একটি তৃষ্ণার্ত উটের জিভের কাছে
অবিকল সরু রাস্তাটি খোলা
অনেকদূর নেমে গ‍্যাছে, মানুষের পিলপিলে মাথা পর্যন্ত
এই গ্ৰ‍্যাভিটি
এই আমুদে রক্ত কোথায় রাখে কে?
নিয়ন তার চাইতে নিরপেক্ষ, মানুষ ও মনীষাকে সমান চোখে দেখে একদিন
সমান ভাবে মরে যেতে বলেছিল
আর একদিন খুলে ফেটে বটানি। নিছক তারার গর্ভ থেকে উটখানি
উড়ে যায়
থ‍্যাঁতলান মনীষার দিকে। নিয়ন নিরপেক্ষতা বজায় রাখে।

বরফকল, সাটিনের পর্দা ও ফ্রেম সরিয়ে
আদিগন্ত প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের মানুষ প্লাস্টিকের ওপর লাফাতে লাফাতে চলেছে
প্লাস্টিক ফেটে পড়ছে প্লাস্টিকে...

একটি উট হেসেছিল, গ্ৰীবাকে সে চেনেনি তখনো
স্বাভাবিক                                       মোহাব্বতে ভরা পশুলোম
তার বেশী কিছু নয়
আট বছর আগে
মুথাঘাসের কাছে।


ইন্দ্রনীল ঘোষ এর কবিতা

পাখি পাখি হল সমস্ত মাস
কবেকার জুন হওয়া শহরের পাশাপাশি
হাত আর চুড়ির গঠন যাচ্ছে উড়ে
দিকে দিকে হয়ে পড়ছে আজ


প্রিয় সম্পাদক- ১ ।। সব্যসাচী সান্যাল

বধিরতা নিয়ে কামারশালায় চরিতার্থ হতে ঢুকে পড়াএতটাই ভ্রমণ আমার। ফিরে আসি ক্ষতের ভেতরে, পরিখার মাঝমধ্যিখান থেকে দেখি যাপনে কেঁপে উঠছে পৃথিবীঅথচ আমার ক্রাইসিসটুকুই আমি, বাদবাকী শুধুই সময়। প্রতি রোববার মাংসের ঝোলে হাত ডুবিয়ে সংযম খুঁজি, আলুর টুকরো উঠে আসে, পরিখা ভরে যায় কুলগাছে লাক্ষা ক্ষরণেএই আমার বধিরের জন্য লেখা গান, এই আমার নির্মাণটুকুযা ক্রমশ বড় হয়ে ওঠা সময়ের বাইরে বসে শুনতে পায় উপদ্রুত জল থেকে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে উঠে আসা ডাকধীবর ধীবর...


বিনির্মাণ করলেন প্রদীপ চক্রবর্তী

তুলনামূলক ময়ূর ।। প্রদীপ চক্রবর্তী

দু' একটা মরসুম 
এই রাস্তা , রাস্তা রঙ
দু পায়ে তোমার দেশান্তরী  
নতুন ব্যতীত শব্দে 
মনে করো রোজ যেখানে গন্ধ ওঠে ,
গন্ধ ঢলে
মায়াবী বেদনায় 

পুরনো ফ্রেম দেখলে যে র 'ম
মাইল খানেক মৃদু হেসে দূরে যায় 
বিশদে ফোটে নি 
লং শট
জলপাইরঙের ডলোমাইট
বর্ণের বর্গী  
তুলনামূলক পড়ে আছে ভুক্ত অন্ধকার 

সাদা আর নীল নিঃসাড়
মধ্যমায় প্রসারিত 
তোমার অভিমান কারুকাজ  
পঙ্খী পায়ে পড়ন্ত ময়ূর 
পেছনে বৃষ্টি উদ্গত
ময়ূর নামে
দেখা যায় হেলানো ময়ূর 
খুলে রাখে পরচুলা  
মুখোশ মদিরাক্ষী
কী সুন্দর ময়ূরের মিছিল  
ময়ূর টপকে যাচ্ছে দ্রুত 
ময়ূরের কু - ডাকে 
দলে দলে নগরবাসীরা দেখে 
ও কাদের ময়ূর যায় 
কিবা রূপ 
কাছে এসে ঝুঁকে বলে , চলো
ময়ূরটুকু করে আসি শেষ ...

সূত্র: আট বছর আগের একদিন ।। নবেন্দুবিকাশ রায়


একটু খোলাপাখির জন্য ।। প্রদীপ চক্রবর্তী 

অম্বর মনে হবে ...
কখনো আঙুলে ছিটের ফ্রক ,
পাখির লাগিয়া এই মুন্নি  

যেদিকে হাওয়াফেরি         গোয়ালন্দ ডাক
রিলিফের ধুলোমুঠি মেঘ 
সরু একটা সুতোর পরে নীলফিটন ...

বিলিতি গানের ভলিউমে ডাকবাক্স যাচ্ছে 
তারও এক একটা মুখ 
                                  রাস্তার ভিড়ে 
                                     তৈরী করা টমটম

রিংটোনে আসমানি সোনেলাল  
        পাখি থেকে নতুন বাড়িটার কেয়ারটেকার  
দেড়খানা রঙ কেবল।
                       দুটো - একটা জানলা।
                                   একটিই পালক ...

সূত্র: ইন্দ্রনীল ঘোষের কবিতা


ঘরকুনো ।। প্রদীপ চক্রবর্তী 

তুমি দেখলে ,
ঝরাপাতার গন্ধে দেহাতি আগুন ছড়িয়ে গেলো ,

কতদিন পর কী রকম ভাবে দেখলে 
দেখলে ধ্বংসস্তূপের নির্মেদ উপেক্ষা লগ্নে।
অচিন  
          আততায়ী 
ওরই পুবে
                           আকরিক আঁকা ...

শব্দ নয়। নিঃশব্দও নয়।
সিঁড়ি
         দিয়ে 
                 নামতে 
                             নামতে 
আমি তোমার কথা 
মনে রাখার মতো কোনও কথাই
মনে রাখতে পারবো না ...

জ্বলে পুড়ে আকাশী ও গাঢ় নীল রঙের কত টুকু তফাৎ বুঝবে মাটি ? তোমার শেষতম সুতোর সরম  
         অবশ  
                   শরীর 
থেকে 
                                      খসে 
                                               যাচ্ছে ...

শরীরের উঁচু নিচু ভাষা পদ্ধতি সমস্ত প্রশ্নের  
কল্পনায় প্রসারিত হতে হতে , হয়তো বা থেমে গেছে 
         কোথাও হয়তো থামে নি ...

সুখের লাগিয়া এই জানলা ধরে দুপুর গড়ানো বুকের মরশুম চলে যায় দূরে | লম্বা সাঁকোটা বেশ নড়বড়ে ছিল জেনেও দিনানুদৈনিক মুসাফির 
                 এবং 
লালসা আমার কাছে এক হয়ে যায় ...

সূত্র: প্রিয় সম্পাদক ।। সব্যসাচী সান্যাল


নির্মাণে বিনির্মাণে
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক

       নির্মিতই হোক আর বিনির্মিতই হোক দুই-ই কবিতার চোরাবালি। সাধারণত প্রথম ভাষ্যলিপি যে মগজ থেকে, বলি নির্মাণ। আর সেই অনুষঙ্গে পাঠক-কবির মগজ থেকে ভাষা পেলে বলি বিনির্মাণ। এই সাধারণতটা ততটা সত্য নয়। কেননা, কবির চেতনায় যা স্পৃষ্ট, যা ভাবনার পল্লবায়নে মস্তিষ্কে প্রবাহিত, তারই পুনর্গঠন তথা বিনির্মান ভাষায়। কতটুকু আর প্রতিফলিত ও প্রতিভাত হয়? মাথাতেই থেকে যায় সেই স্পৃষ্টতা। সুতরাং প্রথমে যে রূপ বা ভাষা-আকার আমরা দেখি তা বিনির্মিতই। যাক, তুলে রাখি এই কচকচি। কবিতায় ফেরা যাক।

       কবি প্রদীপ চক্রবর্তী দেবাদৃতা বোসের প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা নিয়ে কবিতা করেছেন। তাই বলে তিনি বাধ্য নন মূল কবিতা থেকে প্রেরণা খোঁজার। তিনি তা খোঁজেনও নি। বরং নিজস্বতাসহ প্রদীপ ভিন্ন তিনটি কবিতা লিখেছেন।

       কবি নবেন্দু বিকাশ রায়ের কবিতা লেখার ঢং-টি স্বাভাবিকভাবেই অনুপস্থিত কবি প্রদীপ চক্রবর্তীর কবিতায়। আবার নবেন্দুর কবিতা পড়তে গিয়ে হোঁচট খাওয়া যেতে পারে, এই ভেবে, যে এ-কোনো এক প্রবাদপ্রতীম প্রায় মিথ হয়ে যাওয়া পূর্বজ কবির গভীর প্রেরণায় লেখা নয়তো? হলেই বা! তিনি যখন লেখেন— 
                    "বরফকল, সার্টিনের পর্দা ও ফ্রেম সরিয়ে
                    আদিগন্ত প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের মানুষ প্লাস্টিকের ওপর লাফাতে লাফাতে চলেছে
                    প্লাস্টিক ফেটে পড়ছে প্লাস্টিকে…"

       তখন কিছু মানুষ হোঁচটটা সামলেও নিতে পারেন সহজেই। কিন্তু প্রদীপের কবিতায় সেই হোঁচট খাওয়ার ভয়টি মোটেও নেই। তিনি সমান্তরালে না হেঁটে লেখেন
                       " মাইলখানেক মৃদু হেসে দূরে যায়
                       বিশদে ফোটেনি
                       লংশট
                       জলপাইরঙের ডলোমাইট
                       বর্নের বর্গী
                       তুলনামূলক পড়ে আছে ভুক্ত অন্ধকার।" 

       একজন এনেছেন উট, তার গ্রীবা, মুথাঘাস; আরেকজন ময়ূর, মুখোস, পরচুলা। ভাব ও ভাবনায়, শৈলীতে, অনুসরণে যথেষ্ট মিল না রেখেও আমরা পেয়ে যাই অনবদ্য দুটি কবিতা। কোথাও একটা সুতোর টান থাকলেও থাকতে পারে, যা প্রকাশ্য নয়, অন্তর্লীন।

       কবি ইন্দ্রনীল ঘোষ-এ এসে প্রদীপ কি আপাত ঘূর্ণায়মান চাকাটা অন্যদিকে ঘোরাবেন? দেখা যাক। না, তিনি ঘোরান নি। বহমান রেখেছেনইন্দ্রনীল ঘোষের কবিতাটি পড়েতাঁর উৎপাদনে। শুধু এখানে দুজনেই ব্যবহার করেছেনপাখিশব্দটি, বস্তুটি, প্রাণটি। উপজীব্যতা ভিন্ন, ভাবনা একটেরে নয়, ভাষা তো নয়ই। মাত্র চারটি পঙক্তিতে সংহতভাবে ইন্দ্রনীল পাখিকে সমস্ত মাসে পর্যবসিত করে, তাকে না উড়িয়ে, উড়িয়েছেনহাত আর চুড়ির গঠন’, যার উড়ান এক কল্পনা মাত্র।পাখিআরহাত আর চুড়ির গঠনআদতে প্রতীক না হয়েও, সমার্থক হতেও পারে আবার না-হতেও পারে। সম্ভাবনাটি দুলিয়ে রেখেছেন পাঠকের জন্য।দিকে দিকে হয়ে পড়ছে আজনা পড়ে যদি পড়া যায়আজ দিকে দিকে হয়ে পড়ছে’, তাহলে ভাব-রসটি বিঘ্নিত হয় না। কেননা, যাযাচ্ছে উড়েতাইদিকে দিকে হয়ে পড়ছে আজবা, যাযাচ্ছে উড়েতাইআজ দিকে দিকে হয়ে পড়ছেকিন্তু যদি, ‘আজনিজেইদিকে দিকেহয়ে পড়ে, তাহলে ভিন্নতা আসে। এভাবেই এক বহুমাত্রিকতা জুড়ে থাকে এর সঙ্গে। আর প্রদীপের কবিতা ততটা সংহত না হলেও, তিনিপাখির জন্য রাখেনঅম্বর’, ‘ছিটের ফ্রকআরমুন্নিএরা যেন পরস্পর একটা সম্পর্ক স্থাপন করতেই পারে। তাঁরপাখি’, ‘নতুন বাড়ি’, ‘কেয়ারটেকার’, ‘দুটো একটা জানলাআরএকটিই পালক’-এর সঙ্গেও সহজেই আমরা একটা সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারি। তাঁরডাকবাক্সওড়ে না, যায়বিলিতিগানের ভলিউমে’, ‘ডাকবাক্সের’ ‘এক একটা মুখ’ ‘তৈরী করা টমটম’, যা চলে। এখানেও একটা সম্পর্কের সংযোজন সম্ভব কল্পনার জালটি প্রসারিত করে। সব মিলিয়ে এমন কিছু অনুষঙ্গ কবি একত্রে জড়ো করেছেন, যাদের সম্ভাবনার মাধ্যমে সম্পর্কযুক্ত করা চলে। তারপরেও কবিতাটিতে একটি রেখার চিন্তাসূত্র নেই, বরং যুক্তিহীনতা রাখা হয়েছে ইচ্ছে করেই, পাঠকের কথা ভেবে। পাঠকের ওপরেই দায়িত্ব সেই যুক্তিহীনতার মাঝে কবিতাটি নিজের মধ্যে বাজিয়ে তোলা, এমনই নির্মাণকৌশল। ওঠেই তাই। এ-ও বহুমাত্রিকতাই, কিন্তু তা ভিন্ন পথে। আমরা আবারও পেয়ে যাই ভিন্ন স্বাদের আর কৌশলের দুটি আলাদা কবিতা, বাহবা প্রাপ্যের।

       ‘আমার ক্রাইসিসটুকুই আমি, বাদবাকী শুধুই সময়কবি সব্যসাচী সান্যালের এমন অনুভব আর পরিজ্ঞানের কথা শোনা যায় তাঁরপ্রিয় সম্পাদক-১নামে টানা গদ্যে লেখা কবিতায়। কবিরবধিরের জন্য লেখা গান’-ই তাঁরনির্মাণটুকুযা, ‘বড় হয়ে ওঠা সময়ের বাইরে বসেশুনতেও পায়জল থেকে, ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে উঠে আসা ডাকতিনি নিজেই বধির। কেননা, ‘চরিতার্থ হতেতিনিবধিরতা নিয়ে কামারশালায়ঢুকে পড়েন, ভ্রমণে।ক্ষতের ভেতরেফিরে আসেন, দেখেনযাপনে কেঁপে উঠছে পৃথিবীস্বভাবতই সব মিলিয়ে কবি ক্রাইসিসের মধ্যে খুঁজে পান তাঁর অস্তিত্ব। বধির, কিন্তু চক্ষু-ইন্দ্রিয়ে দেখেন পৃথিবীর কাঁপন। সংযম খোঁজেন। নিজের জন্যই লেখেন গান, যা সময়ের বাইরে বসে শুনতে পায় ডাক। ইত্যাদি। কবিতায় একটা মোহময়তা আছে। নিজেকে নিয়ে কাটাছেঁড়া আছে। আর আছে প্রণিধান। একটি আদ্যন্ত কবিতা। কবি প্রদীপ চক্রবর্তী এই প্রথম লিখলেন, ‘সব্যসাচী সান্যালের প্রিয় সম্পাদক কবিতাটি পড়ে আমি যে কবিতাটি লিখলামনাম দিলেনঘরকুনোভ্রমণের উলটোরকম কথা। শুরু করছেন এইভাবে— তুমি দেখলে/ ঝরাপাতার গন্ধে দেহাতি আগুন ছড়িয়ে গেলোআমি নয়তুমি দেখলেকবিতায় আমি এক জায়গায় আছে। তা এভাবে—‘আমি তোমার কথা/ মনেরাখারমতো কোনও কথাই/ মনে রাখতে পারবো নাব্যস্‌, এটুকুই। এখানেও তুমি। প্রায় শেষ হচ্ছে এইভাবে—‘তোমার শেষতম সুতোর সরম/ অবশ/ শরীর/ থেকে/ খসে/ যাচ্ছে…’তুমি, তুমি। অবশ্য একদম শেষ হচ্ছে আমি দিয়ে, ‘লম্বা সাঁকোটা বেশ নড়বড়ে ছিল জেনেও দিনানুদৈনিক মুসাফির/ এবং/ লালসা আমার কাছে এক হয়ে যায়…’এসব উদ্ধৃতি দিয়ে কী বোঝানোর চেষ্টা? চেষ্টা এই, সব্যসাচীর কবিতায় কেন্দ্রে আমি এবং আমার চেতনা। প্রদীপের কবিতায় তুমি এবং তোমার চেতনার বকলমে আমি। প্রদীপের কবিতায় মুন্সিয়ানায় বৈপরীত্য আনা হয়েছে।শব্দ নয়। নিঃশব্দও নয়।বৈপরীত্য। এ-কোনো বিশেষ অবস্থান নয়, বরং শব্দই।জ্বলে পুড়ে আকাশী ও গাঢ়নীলরঙের কতটুকু তফাৎ বুঝবে মাটি?’জ্বলেপুড়ে কালো হয়, তামাটে হয়, লাল হয়। কবি যে রং বলছেন তা হয় না। বৈপরীত্য।ঘরকুনোআবার শেষেমুসাফিরবৈপরীত্য। যেমনতুমি’ ‘আমিও এক বৈপরীত্য। আবার এই বৈপরীত্য অনধিগম্য নয়, এখানেই মুন্সিয়ানা। ইচ্ছাকৃত বৈপরীত্যে গঠিত কবিতাটি স্বাভাবিকভাবে পেয়েছে এক অগ্রগতি, গতি, এক বিশেষ চলনও। সাধু। ফলে আমরা পেয়ে গেলাম দুটি ভিন্ন জাতের কবিতা। সুরে স্বরে ভাষায় গঠনে ভিন্ন মাত্রার।

       ফলে, বিনির্মিত কবিতাগুলো আসলে নির্মিতই। অথবা, প্রথমবারে বিনির্মিত কবিতাগুলো আরেকবার বিনির্মিত হলো।







আপনার মূল্যবান মতামত: