সম্পাদকীয়



       ‘অতিথি সম্পাদক’ হলে সম্পাদনার কাজটা ঠিকভাবে করা যায় কিনা তা নিয়ে আমার বেজায় সন্দেহ আছে। শব্দটির মধ্যে একটা দূরত্বের ঘ্রাণ উপস্থিত হয়ে দূরতুতো করে দেয়। বরং ‘এ-সংখ্যার সম্পাদনা’ অনেক আত্মীয়ভাবের দ্যোতক। সে যাই হোক, উদ্দেশ্যটা হয়তো একই। প্রায় মাস দশেক আগে ‘রেহেল’-এর ( একটি ই-ম্যাগাজিন) মূল সম্পাদকরা যখন আমাকে আগামী সংখ্যার সম্পাদনার দায়িত্ব নিতে বলে, তখন দ্বিধাগ্রস্ত ছিলাম। কারণ, সম্পাদনার কাজ ছেড়েছি বহুদিন, আর প্রায় উদ্দেশ্যহীনভাবে পাঁচটা কবিতা, তিনটে গল্প, দুটো গদ্য/ প্রবন্ধ-নিবন্ধ প্রকাশ করে দেওয়া কোনো সাহিত্যপত্রিকার কাজ হতে পারে না, এমন বিশ্বাস ক্রমে প্রত্যয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই। তবে, তারা যখন প্রস্তাব দিল, আপনার সঙ্গে আলোচনা করে কবিতা নিয়ে একটা প্রকল্পের কথা ভাবা যেতে পারে এ-সংখ্যার জন্য। ব্যস্‌, রাজি হয়ে গেলাম। তারপর, আলাপ-আলোচনা এবং এই দশমাসের গর্ভযন্ত্রণা। প্রসবে যার নিরাময়।

       প্রকল্পটা গড়তে তাপ-উত্তাপে যেমন হাত-পা সেঁকেছিলাম, তার প্রতিটি পরতের কথা ভেবে যেভাবে উল্লসিত হয়েছিলাম, বা, বেশ মজার আর সোজা ভেবেছিলাম, প্রয়োগে এসে তেমনই কঠিন, সমস্যাগ্রস্ত, আর অসহ বলে মনে হয়েছে। হা ভাবজগত, আর বাস্তব ক্ষেত্রভূমি! তবু সে আলোয় এল তমসা থেকে, স্ব-রস বেরিয়ে এল গর্ভ থেকে একদম মনিটরে, এই যা খুশির কথা।

       আসলে গঠিত প্রকল্পটা ছিল, তিনটি ধাপে, কিছুটা জটিল প্রক্রিয়ার। কবি/গদ্যকার নির্বাচন এবং জোড় বাঁধা। প্রথমধাপে জোড়ের প্রথমজন নির্বাচিত করে দেবেন তাঁর প্রিয় বা পছন্দের তিনটি কবিতা, দ্বিতীয়জনও তাই করবেন। এবারে হবে ‘বাক্সবদল’ (নামটা জয়দীপ মৈত্র-র দেওয়া), যা দ্বিতীয়ধাপ। প্রথমজনের নির্বাচিত কবিতা পাঠানো হবে দ্বিতীয়জনের কাছে আর দ্বিতীয়জনেরটা প্রথমজনের কাছে পুনর্নির্মাণ বা বিনির্মাণের জন্য। তৃতীয়ধাপে আরেকবার ‘বাক্সবদল’। নির্মিত/ বিনির্মিত কবিতা নিয়ে দুই কবির গদ্য। এতে কয়েক দফার চালাচালি আর সময়ক্ষেপ।

       কবি নির্বাচনের ক্ষেত্রে আমরা একটা দৃষ্টিভঙ্গির কথা মাথায় রেখেছিলাম। সেটা হলো, প্রচল ধারাকবিতার বদলে যাঁরা অন্যরকম, নতুন, অপর ইত্যাদি লেখেন বা পছন্দ করেন, বা আবহমান বাংলা কবিতায় বিশ্বাস রেখেও যিনি স্বতন্ত্রতার পরিচয় দেন, সংস্কারে ভিন্নমাত্রা জুড়তে পারেন, তাঁদের তালিকায় রাখা। দ্বিতীয়ত প্রবীণ, মধ্যবয়সী, তরুণ এবং একদম হালে কবিতা লিখতে আসা কবিদের তালিকায় রাখা। আশা করি এ-দুটোই আমরা পেরেছি।

       দু-একজন বাদে তালিকাভুক্ত কবিরা এই প্রকল্পের অংশীদার হয়েছেন সানন্দে। দু-একজন প্রথমে নিমরাজি হলেও পরে অংশ নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ উচ্ছ্বাসও প্রকাশ করেছেন। কেউ আবার নিজেই তৎপরতা দেখিয়েছেন প্রকল্পের বিষয়ে, বিশেষত ‘রেহেল’-এর মতো একটি পত্রিকায় কাজ করতে। আমরা জানি, কবিরা স্বেচ্ছায় আর আনন্দে এই কাজটি করেছেন, এবং এটি ছিল তাঁদের কাছে একটা চ্যালেঞ্জের মতো। প্রথমত নিজ প্রিয়/পছন্দের মাত্র তিনটি কবিতা বাছা সত্যিই এক ঝকমারি কাজ। দ্বিতীয়ত বিনির্মাণ করা, যাতে অনেকেরই অনেক সময় সায় থাকে না। তৃতীয়ত নির্মিত/বিনির্মিত কবিতা নিয়ে গদ্য লেখা, যাতে কেউ কেউ স্বচ্ছন্দবোধ করেন না। কিন্তু তাতে তাঁরা সমর্থ হয়েছেন বলেই আমরা মনে করি। এখন পাঠকের দরবারে…

       এ-সব ক্ষেত্রে হানড্রেড পার্সেন্ট অ্যাচিভমেন্ট বোধহয় কখনোই সম্ভব হয় না। আমরাও পারি নি। ব্যর্থতা আমাদের সঙ্গী হয়েছে। আমরা দু-একজনকে দিয়ে প্রকল্পের সব কাজ করিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছি। শত অনুরোধ ও তাগাদা ব্যক্তিক অসুবিধা দূর করার পক্ষে যথেষ্ট ছিল না। হতেই পারে, কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছিল। এই ব্যর্থতাও ছিল আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ, এবং ব্যর্থতাকে ওভারকাম করতে নিতে হয়েছিল কিছু সদর্থক সিদ্ধান্ত। নয়তো, আজও পত্রিকাটি হয়তো আন্তর্জালে ধরা পড়ত না।  সেইসময় অসুবিধার মধ্যেও যাঁরা আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের স্যালুট।

       আমার বন্ধুদের আর সব অনুজদের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞ। কৃতজ্ঞ টিম ‘রেহেল’-এর কাছে যারা কোনো-না-কোনোভাবে এই প্রকল্পে আমাকে সহায়তা করেছেন।

       গত সংখ্যার প্রকল্পের নাম ছিল ‘রুমাল চুরি’। সেটিও ছিল বেশ নতুন পদক্ষেপ। আমার আশা টিম রেহেল’ আগামী দিনেও এই কার্যধারা অব্যাহত রেখে, বাংলা কবিতার অনাবিষ্কৃত অনালোকিত অভিনব অঞ্চলগুলিকে চিহ্নিত করে বৈচিত্র্যময় প্রকল্পে তাদের স্বপ্নের ‘রেহেল’-এর পৃষ্ঠাগুলো ভরিয়ে তুলবেন।

       নমস্কার ও ভালোবাসা।


আপনার মূল্যবান মতামত: